শ্যামল সান্যাল : রাজা না থাকলেও আছে রাজভবন। গভর্নর জেনারেলের বাড়ি পরে হল গভর্নর হাউস। মানুষের কথায় লাট সাহেবের বাড়ি। বিশাল ওই প্রাসাদ বহুদূর থেকেই দেখে আসছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। ওই বিশাল প্রাসাদের সিংহ দরজার মাথায় বসে সিংহ। পাগড়ি পরা, ঘোড়ার পিঠে বসে মাথায় পাগড়ি দ্বার প্রহরী সেই সিংহ দুয়ার আগলে। আজও লন্ডনে রানির সরকারি প্রাসাদের সামনে একই ছবি দেখা যায়। বাকিংহ্যাম প্যালেস তার নাম।
কলকাতার এই রাজভবনে সামনে এখন আর সেই রাজকীয় স্টাইলে আরবি ঘোড়ার পিঠে সওয়ারিদের বদলে দেখা মেলে কলকাতা পুলিশের নানা রকমের গাড়ি, সাদা ইউনিফর্মের পুলিশের। দূর থেকেই দেখা যায় নুড়ি ছড়ানো পথ, বিশাল বিশাল থাম। সিঁড়ির মুখে ফিনিক্সে বসে। মিশরের পিরামিডের প্রহরী, কলকাতার রাজভবনও আগলে বসে ২০০ বছর ধরে। পিরামিডকে ওরা পাহারা দিচ্ছে ৫ -৬ হাজার বছর ধরে। মিশরের ফারাওদের সঙ্গে তাঁদের রানিদের মৃত্যুর পরে সমাধি দেওয়া হত। সঙ্গে বহু অলঙ্কার এবং ভৃত্যকুল।
পিরামিডের ইতিহাস অসাধারণ। কিন্তু সেদিনের সুতানুটির গভর্নর-জেনারেল হাউসে শুধুমাত্র মিশরের ফিনিক্স নয়, আছে চিন থেকে সেই সময়ে তুলে আনা কামান। ড্রাগনের পিঠে রাখা চমৎকার কারুকাজ করা এই শিল্পকর্মটি ছাড়াও রাজভবনের ঠিক সামনেই আছে চিনের কামান। ন্যানকিং থেকে এই কামান আনা হয়েছিল তখনকার গভর্নর -জেনারেল এডওয়ার্ড লর্ড অ্যালেনবরোর সময়ে। চিনও তখন ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ। লর্ড অ্যালেনবরো এই কাজের জন্য একটা উপলক্ষ্য ঠিক করে বলে ছিলেন , “the Peace dictated to the Emperor of China under the walls of NANKING by the forces of England and of INDIA.” এটা ১৮৪২ সালের ঘটনা।
রাজভবনের মাথায় যে গোলাকার গঠন দেখা যায় প্রথম দিকে তা ছিল না । লর্ড এলগিনের আমলে এই ডোমটি তৈরি হয়। ৬০টি ঘর নিয়ে ওপরের তলায় সেদিনের গভর্নর -জেনারেলদের বাস। ইলেকট্রিক নয়, তেলের সেজে বাতি, ঝাড় জ্বলত। চওড়া খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হত। লর্ড কার্জনের সময়ে লিফট বসানো হয়েছিল, খাঁচার মত দেখতে ভিক্টোরিয়ান আমলের এই লিফট কিন্তু আজও ওঠে-নামে । রাইটার্স বিল্ডিংসের মেন গেটে প্রায় একই ধাঁচের লিফটিতে অনেকেই চড়েছেন। এই লিফট দুটি অনেক ইতিহাসের সাক্ষী।
লাটসাহেবের বাড়িতে বিদ্যুৎ এসেছিল ১৮৯৯ তে । গ্যাসের লাইন এলো ১৮৬৩ সালে। বাথরুমে ঠান্ডা -গরম জলের ব্যবস্থা হয়েছিল ১৮৭২-এ। আর সেই আমলের আধুনিক চান ঘর হলো এই তো ১৯০৫ সালে। রাজভবনে ৬০টি ঘর ছাড়াও আছে বিশাল বিশাল টানা বারান্দা, পাবলিক হল, পোর্টিকো, বড় ও সুন্দর একটি থ্রোন রুম। এখানেই একের পর এক মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছে। হয়েছে নানা অনুষ্ঠান।মার্বেল হলটিতে একসময়ে ব্রিটিশ শাসকদের পাশে ইংরেজ পত্নীদের মূর্তি, হাতে আঁকা ঐতিহাসিক ছবি ছিল। সেগুলি একসময়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল স্বাধীনতার পরে। পরে আবার বেশ কিছু মূর্তি ছবি ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।
রাজভবনের রান্নাঘরের গল্পও খুবই সুন্দর। প্রশিক্ষিত শ্যেফ, বাবুর্চি আছেন। দার্জিলিং এর সেরা চা ছাড়া অন্য কিছুই চলে না। বেকারি আছে ।সেই বেকারির বিস্কুট, কেক, প্যাস্ট্রি , ব্রেড, এখনও অসাধারণ। আছে একটি খুব ভালো লাইব্রেরি।ঐতিহাসিক নথি পত্র,বই থরে থরে সাজানো। অভিজ্ঞ লাইব্রেরিয়ান ও শিক্ষিত কর্মীরা উৎসাহী গবেষক, পাঠকদের সাহায্য করেন।
আর আছে অজস্র দুর্লভ ফল ও ফুলের গাছ। ২০০ বছরের প্রাচীন গাছও মিলবে। গাছ থাকলেই নানা চমৎকার সব পাখি তো বাসা বাঁধবেই। কাঠবেড়াল, ভাম, তারাও আছে।একসময়ের ইংরেজ শাসনের কেন্দ্রবিন্দু অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কত গভর্নর জেনারেল থেকে আজকের রাজ্যপালদের অনেক কাণ্ডের সাক্ষী এই প্রাসাদ। কেউ ছিলেন কবি, কেউ পুলিশ, গানবাজনা ভালোবাসতেন, খাদ্য রসিক, টাটকা দুধের ভক্ত বলে ছাগল, গরুর গোয়াল করে দিব্যি কাটিয়ে গেছেন। এ সব দেখেই চলেছে রাজভবনের থাম, দেওয়াল।
এখনকার রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় অবশ্য রাজভবনকে যেভাবে প্রচারের আলোয় এনেছেন, তা আগে কখনও হয়েছে কিনা, ওয়াকিবহাল মহল মনে করতে পারছেন না। রাজ্যপালদের নিয়েও কত কাহিনী ছড়িয়ে আছে। তেমনই গল্পের শেষ নেই দারজিলিংয়ের রাজভবনের সঙ্গে ব্যারাকপুরের লাট ভবন নিয়েও।
(চলবে)
স্কেচ : ডেসমন্ড দোয়েগ , সংগ্রহ :শ্যামল সান্যাল।