বছরের শেষ উৎসব চড়কের মেলাকে ঘিরে প্রচলিত আছে বহু লৌকিক বিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠান। তবে চড়কের মূল অনুষ্ঠান শিবের গাজন। কথিত আছে, শিবের উপাসক বাণ রাজা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত ও ক্ষত বিক্ষত হয়ে শিবকে তপস্যায় তুষ্ট করার জন্যে নিজের রক্ত দিয়ে সাধনা করেন।
সেই পৌরাণিক কাহিনীকে স্মরণ করে ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা সুন্দরানন্দ ঠাকুর চড়ক অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। এও শোনা যায়, ঋণে জর্জরিত কৃষকরা, যাঁরা বৎসরান্তে ঋণ পরিশোধ করতে পারতেন না, তাঁদের পিঠের চামড়া বঁড়শিতে গেঁথে ঝুলিয়ে চড়ক গাছের চারদিকে ঘোরানো হত।
১৮৬৩তে ব্রিটিশরা আইন করে এই প্রথা রদ করলেও ১৮৯০ পর্যন্ত এই প্রথার ভালোমতোই প্রচলন ছিল।আজও গ্রামাঞ্চলে এই প্রথার দেখা মেলে। চড়কের দিন নীলপূজা হয়। আগের দিন চড়ক গাছ ধুয়ে পরিশ্রুত করে রাখা হয়। একটি জলপাত্রে শিবলিঙ্গের সঙ্গে একটি সিঁদুর মাখা কাঠের পাটাতন বা “শিবের পাটা” রাখা হয়। পুরোহিতরা একে বুড়ো শিব বলে থাকেন।
পতিত ব্রাহ্মণ এই পুজোয় পৌরোহিত্য করেন। কুমির পূজো, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর হাঁটা, কাঁটার উপর লাফানো বা পায়ে দড়ি বেঁধে ঝুলে থাকা, আসূর্যাস্ত জিভে লোহার শলাকা বিঁধিয়ে রেখে সেটা সন্ধ্যায় জলে ফেলে দেওয়া, শিবের বিয়ে, অগ্নি নৃত্য, সং, জ্বলন্ত লৌহার শলাকা গায়ে বিঁধিয়ে দেওয়া ইত্যাদি এই উৎসবের অঙ্গ।
নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও আজ এগুলির প্রচলন আছে।শারীরিক কৃচ্ছ্রসাধন এই অনুষ্ঠানের অন্যতম অঙ্গ।বাণ সন্ন্যাস, বেত্র সন্ন্যাস (যাতে পিঠের চামড়ার মধ্যে দিয়ে বেত ঢুকিয়ে দেওয়া হয়), বঁড়শি সন্ন্যাস ইত্যাদি ভয়ানক সব আচার এই উৎসবের সঙ্গে জড়িত।
যদিও এর অনেকটাই আজ লুপ্তপ্রায়। মহারাষ্ট্রের বড়াগ, সিকিম ও ভূটানের চোড়গ, শ্রীলঙ্কার টুককুম, অন্ধ্রের সিরিমনু বা সুদূর মেক্সিকোর ড্যান্সা ডে লো ভোলাদরস-এর সঙ্গে বাংলার চড়কের অনেক সাদৃশ্য আছে। চড়কের আদিম রূপটির চেয়ে বর্তমান রূপ অনেক উজ্জ্বল, মার্জিত ও আনন্দময়। বর্তমানে চড়ক শুধুই আনন্দোৎসব, শারীরিক কষ্ট এই উৎসবে আজ আর জায়গা পায় না।