দেবদাস কুণ্ডু
কতো লেখক কতো শিল্পী
এঁকেছেন মানুষের ছবি
গঙ্গা অজুর্ন বিবর
আমি দেখেছি মানুষ সুন্দর।
তখন আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে ঢোকা খুব সহজ ছিল। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করতো না। ঘট ঘট করে উপরে উঠে যেতাম। কখনও লিফটে, কখনও সিঁড়ি। রবিবারের আনন্দমেলার পাতায় আমি নিয়মিত বাচ্চাদের গল্প লিখতাম। যেতাম পার্থ বসুর কাছে। তিনি ঐ পাতাটা দেখতেন। সঙ্গে বইপত্রর টুকরো খবর লিখতেন। শেষে লেখা থাকতো প. ব.।মানে পার্থ বসু।
লম্বা করিডোর। দুপাশে কাঁচের ঘর। ঘরের ফাঁকে ফাঁকে দেওয়ালে বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি। বাঁ পাশে রবিবাসরীয় দপ্তর। ভিতরে বসে আছেন উদাসীন আত্মমগ্ন গম্ভীর লেখকদের লেখক রমাপদ চৌধুরী। আমি সেই ঘরেও যেতাম। রাধানাথ মন্ডলের কাছে। আমি তখন বেকার। রবিবারের পাতায় ফিচার লিখি। রমাপদ চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করি, খুব ইচ্ছে হতো আমার। তাঁর এক একটা উপন্যাস পড়ে আমি মুগ্ধ। কিন্তু সাহসে কুলাতো না।রাধানাথদার কাছে লেখা জমা দিয়ে চলে আসি। ঐ রকম ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়ানো যায?
পাশের ঘরটা ছিল দেশ পত্রিকার অফিস। সেখানে গল্প দেখতেন আনন্দ বাগচি। খুব ভদ্রলোক। আমি ডাকে পাঠানো একটা গল্পের খোঁজ করতে একদিন ঢুকেছিলাম। উনি খাতা দেখে বললেন, ‘গল্পটা আন্ডার কনসিডারেশনে আছে। মানে বিবেচনার জন্য ঝুলে আছে। তার ঠিক উল্টো দিকে ছোট্ট কাঁচের ঘরে বসতেন প্রবাদপ্রতিম জুহুরী সম্পাদক সাগরময় ঘোষ। যিনি ভালো লিখতে পারা সত্ত্বেও, নিজে না লিখে লেখক খুঁজে আনতেন। লেখক আবিষ্কার করতেন। প্রথম উপন্যাস লেখার সুযোগ নতুনদের তিনি দিয়েছেন, যাঁরা আজ সাহিত্য জগতে নক্ষত্র। বসে বসে গভীর মগ্ন মনে পড়ছেন হয়তো কোনও উপন্যাসের পান্ডুলিপি। মোটা ফ্রেমের চশমার ভিতর জুহুরী দুটো চোখ।
উল্টো দিকের ঘরটা সানন্দা। একদিন সে ঘরে গেলাম। একটা গল্প জমা দিয়েছিলাম। তার খোঁজ নিতে। তখন সানন্দার সম্পাদক অপর্ণা সেন। একটি মেয়ে, যিনি গল্প দেখতেন, তিনি বললেন, ‘আপনার গল্পটি ইনট্রোভার্ট। আমরা এ ধরনের গল্প ছাপি না। গল্পটা আপনি দেশে দিতে পারেন।’ পার্থদাকে গল্প দিয়ে দু একটা কথা বলে চলে আসতাম।
সেদিন ঢুকে পড়লাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘরে। তিনি তখন খুব মনোযোগ দিয়ে লিখছেন। সম্ভবত তখন তিনি দেশে ‘প্রথম আলো’ লিখছেন ধারাবাহিক। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ লেখার পর তাঁর হুঁশ হলো, তাঁর টেবিলের কাছে একজন দাঁড়িয়ে আছে। লেখা থামিয়ে তিনি বললেন, ‘দাঁড়িয়ে কেন? বসো।’ মুখে কোনও বিরক্তির চিহ্ন নেই। মাঝপথে লেখা থামাতে হলো। এইজন্য। আমি বসলাম। বলল, ‘কি চাই ভাই?
‘কিছু চাই না।’
‘তুমি কে?’
‘আমি দেবদাস কুণ্ডু।’
‘ভালো নাম। একবার শুনলে ভুলবে না। তা আমার কাছে কেন?’
‘কাল সারারাত জেগে আপনার একটা উপন্যাস পড়েছি।’
‘কোন উপন্যাস? ‘
উপন্যাসের নাম বললাম।
‘আচ্ছা।’
‘ঐ উপন্যাসের নায়ক মারা গেছে। অসুখ হয়েছিল।‘
‘অসুখ হলে তো মারা যাবে।’
‘ঐ অসুখটা আমার আছে।’
‘বলো কি?’ তিনি চমকে উঠলেন। তাঁর চোখে আতঙ্ক দেখলাম।
‘ডাক্তার দেখিয়েছো? ‘
‘হ্যাঁ,
‘কি বললেন ডাক্তার?’
‘ওষুধ খেয়ে যেতে বললেন।‘
‘অল্প বয়স। এখন এসব অসুখ—একদম অবহেলা করবে না।’
চা এলো। দুকাপ। আশ্চর্য! আমার জন্য চা? নাকি বলা আছে, আমার কাছে কেউ এলে চা দিয়ে যাবে। যাই হোক।
‘তুমি কি করো?’ চা খেতে খেতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন।
‘আমি বেকার। ফিচার লিখি।‘
‘ফিচার লিখছো লেখো। কিন্তু যদি লিখতে হয় গল্প লেখ। যাতে তুমি বেঁচে থাকবে।’
ওঁনার কাছে বলার সাহস আমার হয়নি যে আমি গল্প লিখি।
চা শেষ করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সিগারেট ধরালেন। বললেন, ‘আগে চিকিৎসা, তারপর লেখা, কেমন?’
সত্যি সেদিন বুঝে ছিলাম এক ব্যস্ত লেখকের প্রায় আধ ঘন্টা আমি নষ্ট করলাম। উনি আমাকে চেনেন না। লেখার সময় গিয়ে হাজির। কথা বললেন। সময় দিলেন। এতো মানবিক হন একজন লেখক! আজ বুঝতে পারছি বড় লেখক হতে গেলে আগে তোমাকে বড় মানুষ হতে হবে।