কমল ভট্টাচার্য
বুদ্ধদেববাবুকে বহু বছর খুব কাছ থেকে নানা অবস্থায় দেখার সুযোগ হয়েছে। উনি রাজ্য রাজনীতিতে ধাপে ধাপে সিঁড়ি ভেঙে উঠে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। আমি বাম রাজনীতি ছেড়ে সাংবাদিকতা করেছি। সাংবাদিক হিসেবে রাজনীতিটা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। ওঁর সঙ্গে আগের মতো ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ না থাকলেও যোগাযোগ ছিল। পেশার সূত্রে যোগাযোগ ছিল সিপিএমের প্রায় সব নেতার সঙ্গে।
বুদ্ধদেবকে ছাত্র নেতা থেকে ক্ষমতার সব থেকে উঁচুতে উঠতে দেখেছি। সুভাষ ও শ্যামল চক্রবর্তীদের ওই অবস্থা থেকেই দেখার ভিত্তিতে বলতে পারি, বুদ্ধবাবু ওঁদের মত রাস্তায় নেমে রাজনীতি করেননি। যেটা করেছিলেন সুভাষ, শ্যামলবাবুরা। বুদ্ধবাবু ছিলেন অনেকটা তাত্ত্বিক নেতা।
তিনি পড়াশোনা, লেখা, চিন্তা ভাবনার জগতে থাকতে ভালবাসতেন। বক্তৃতা ভালোই দিতেন। কিন্তু সে সব বক্তৃতা সুভাষ বা শ্যামলবাবুর মত গরম গরম হত না। আবার জ্যোতি বসুর মত ক্যারিশমাও ছিল না ওঁর। রাস্তায়, গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে মানুষের সঙ্গে মিশে আন্দোলন করার ব্যাপারে তিনি সুভাষবাবুদের থেকে অনেক দূরেই ছিলেন।
কফি হাউস বা শ্যামবাজারে এক চায়ের আড্ডায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়দের সঙ্গে কবিতা নিয়ে কথাবার্তা , নিজে কবিতা প্ৰবন্ধ লেখা বা সিনেমা, নাটক, আবৃত্তি, গান এইসব তাঁর খুব পছন্দ ছিল। প্রমোদ দাশগুপ্ত দলের সম্পাদক হয়ে এক ঝাঁক তরুম মুখ তৈরি করেছিলেন। অনিল বিশ্বাস, বিমান বসু, বুদ্ধদেব, শ্যামল, সুভাষরা সেই দলে ছিলেন।
বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে মন্ত্রী হয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী হিসেবে তিনি কাজ শুরু করেন। প্রথম দিকে তিনি খুবই খোলামেলা ছিলেন। আস্তে আস্তে দলে ও সরকারে তাঁর ক্ষমতা বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও বদলে যেতে শুরু করেন। একদল সরকারি অফিসার, পুলিশ ও কিছু ধান্দাবাজ বুদ্ধিজীবী তাঁকে ঘিরে ফেলতে শুরু করে। তখন থেকেই তিনি আস্তে আস্তে দাম্ভিক, নাক উঁচু বলে পরিচিত হতে শুরু করেন। পুরনো পরিচিতরা দূরে সরে যেতে থাকেন।
একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি মহাকরণে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষার পরে কাজের কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। অথচ ওই সময়ে তিনি তেমন জরুরি কোনও কাজ করছিলেন এমনটা নয়। অনেকের এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু কিছু সুযোগ সন্ধানী তাঁর ঘরে যখন তখন ঢুকে যেতেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুবই খারাপ হয়েছিল কোনও যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়াই।
মহাকরণের বহু পুরনো প্রেস কর্নার ভেঙে সাংবাদিকদের হটিয়ে দিয়েছিলেন অকারণে। এসব ভাবলে সত্যিই দুঃখ হয়। চোখে না দেখে উনি ক্রমশ কানে দেখতে শুরু করেন। আমিও নানা ভাবে এমন বহু ঘটনার সাক্ষী।
দলের সম্পাদক হিসেবে অনিল বিশ্বাস অনেক সময়ে কিছু বিষয়ে আমার কাছে জানতে চাইতেন, বিশেষ করে ভোটের সময়ে। আমি শেষের দিকে বাস্তব পরিস্থিতির কথা বলতাম। সিপিএমের অবস্থা যে ভালো নয়, এই কথা বুদ্ধবাবুকেও বলেছি। উনি আমাকে ভুল কথা প্রচার করছি বলে মন্তব্য করে বহুদিন কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন করতে গিয়ে এসব কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তবে অনেক বিষয়ে বলার থাকলেও তিনি অসুস্থ এবং পুরনো বন্ধু হিসেবে এসব কথা নাই বা বললাম। ২০১১-র নির্বাচনে বাম দুর্গ ধসে যাচ্ছে একথা বাম নেতাদের ব্যক্তিগত ভাবেও বলেছিলাম। বুদ্ধবাবু বাজে কথা বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন সে কথা। কারণ হিসেবে বলেছিলেন, সরকারি রিপোর্ট বলছে বামেরাই ক্ষমতায় ফিরবে।
ভোটের ফল বেরনোর পর আলিমুদ্দিনে দেখা হতে তিনি হতাশ মুখে সরকারি রিপোর্টের একটা ছোট রিপোর্ট পকেট থেকে বার করে আমাকে দেখিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, তা হলে এরা কী আমাকে মিথ্যে , ভুল খবর দিয়েছিল?
আমি কোনও মন্তব্য করিনি। আজ বলতে পারি , চাটুকার প্রশাসন, পুলিশ সেই কাজটা সেদিন করেছিল। আজও তাই করছে না বলি কী করে ?