গত কয়েকদিন ধরে রাজনৈতিক মহলে যে জল্পনা চলছিল, অবশেষে তা সত্যি করে কংগ্রেসে যোগ দিলেন জেএনইউ-র প্রাক্তন ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার। তবে কানহাইয়ার মতো সরাসরি যোগ না দিলেও, কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন গুজরাতের দলিত নেতা জিগ্নেশ মেবানি। নির্দল প্রার্থী হিসেবে গুজরাত বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছেন জিগ্নেশ। তাই কংগ্রেসে যোগ দিলে, তাঁকে বিধায়ক পদে ইস্তফা দিতে হবে। সে কারণেই তিনি শুধু কংগ্রেসকে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন।
জেএনইউ-র ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে জাতীয় রাজনীতিতে উঠে আসা কানহাইয়ার কংগ্রেসে যোগদান এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সাম্প্রতিককালে ভারতের রাজনীতির আঙিনায় যে কয়েকজন তরুণ নেতা বিশেষ নজর কেড়েছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুখ হলেন কানহাইয়া কুমার। অত্যন্ত সুবক্তা কানহাইয়া হয়ে উঠেছিলেন সিপিআইয়ের পোস্টার বয়। তাই তাঁর দলত্যাগ সিপিআইয়ের কাছে যেমন বড় ধাক্কা, তেমনই কংগ্রেসের কাছে এক বড় প্রাপ্তি। বিশেষত উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত এবং পাঞ্জাবের ভোটের আগে কানহাইয়া, জিগ্নেশের কংগ্রেসে যোগদান অন্যমাত্রা পেয়েছে।
কেন কংগ্রেসে যোগ দিলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে কানহাইয়া বলেছেন, “কংগ্রেস একটি বড় জাহাজের মতো। যদি কংগ্রেস বাঁচে, তবেই দেশ বাঁচবে। কংগ্রেস শুধুমাত্র একটি দল নয়, এটি দেশের সবচেয়ে পুরনো এবং সবচেয়ে গণতান্ত্রিক দল।”
২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিহারের বেগুসরাই থেকে লড়াই করেছিলেন কানহাইয়া। কিন্তু বিজেপির গিরিরাজ সিংয়ের কাছে তাঁকে হারতে হয়।
প্রশ্ন হল, কানহাইয়াদের যোগদান কংগ্রেস শিবিরে কি বাড়তি অক্সিজেন জোগাবে? এঁদের হাত ধরে বিজেপির দিকে কতটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারবে কংগ্রেস? বিশেষত রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেসের ঘরোয়া কোন্দল যখন হাইকম্যান্ডকে প্রতিনিয়ত বিড়ম্বনায় ফেলে চলেছে। রাহুল গান্ধীর হাত ধরে কানহাইয়া যেদিন (২৮ সেপ্টেম্বর) কংগ্রেসে পা রাখলেন, সেদিনই পাঞ্জাবে প্রদেশ সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিলেন নভজ্যোত সিং সিধু। অথচ এই সিধুর পীড়াপীড়ির কারণে মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং।
বলতে গেলে, ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেসের ভিতরের ছবিটা বেশ এলোমেলো, হতাশজনক। অসুস্থতা সত্ত্বেও দলের সভানেত্রী হিসেবে কাজ চালাতে হচ্ছে সোনিয়া গান্ধীকে। এই কঠিন সময়ে রাহুলের উচিত ছিল, দলের লাগাম নিজের তুলে নেওয়া। কিন্তু কংগ্রেসের যুবরাজের এ ব্যাপারে খুব একটা হেলদোল লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মাঠে নেমে লড়াই না করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাচ্ছেন।
এই মুহূর্তে রাহুলের উচিত, রাজ্যে রাজ্যে দলকে সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়া। তা না হলে আগামী দিনে কংগ্রেসকে আরও শোচনীয় পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। পাঞ্জাবে দলের কোন্দল যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে আগামী ভোটে কংগ্রেসের ক্ষমতায় ফেরা নিয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের প্রশ্ন, পাঞ্জাবের মতো রাজ্যে কেন সিধুকে দলের সভাপতি করা হল? আর দলের বিশ্বাসের অমর্যাদা করে কেন সিধু পদত্যাগ করলেন?
টালমাটাল অবস্থা রাজস্থানেও। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলটের সঙ্গে সচিন পাইলটের সংঘাত নিত্য খবরের শিরোনাম হয়ে উঠেছে। ছত্তিশগড়ে মুখ্যমন্ত্রী ভূপেল বাঘেলকে সরানোর দাবিতে সরব হয়েছেন কংগ্রেসের বিধায়কদের একাংশ। দলীয় কোন্দলের জেরে মধ্যপ্রদেশ হাতছাড়া হয়েছে। কর্নাটকেও ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে কংগ্রেস। রাহুল গান্ধী মুখে বলছেন, মোদিকে ক্ষমতাচ্যুত করবেন? কিন্তু কীভাবে? শুধুমাত্র টুইট করেই কি বিজেপির মতো সংগঠিত দলকে হারাতে পারবেন?
কেন দলের প্রতি পুরনো নেতাদের মোহভঙ্গ হচ্ছে? কেন প্রাক্তন-রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কন্যা শর্মিষ্ঠা রাজনৈতিক সন্ন্যাস নিলেন?কেন্দ্রে বিজেপি সরকারকে চাপে ফেলার মতো অনেক ইস্যু রয়েছে। কিন্তু উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে কংগ্রেস কোনও আন্দোলনই গড়ে তুলতে পারছে না।
লোকসভা ভোটের আগে তিনটি রাজ্যের নির্বাচন কংগ্রেসের কাছে অ্যাসিড টেস্টের মতো। উত্তরপ্রদেশে দলের যা অবস্থা, তাতে ভোটে সাফল্য পাওয়া খুব কঠিন। জিগ্নেশকে সামনে রেখে গুজরাতে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজ্যে বিজেপির ভিতরের ছবিটাও খুব একটা স্বস্তিদায়ক নয়।
এই অবস্থায় কানহাইয়াদের যোগদান কংগ্রেসকে অক্সিজেন দিতে পারে। কিন্তু রাহুল যদি এভাবে তাঁর ছেলেমানুষি রাজনীতি চালিয়ে যেতে থাকেন, তাতে কংগ্রেসের সঙ্কট বাড়বে ব-ই কমবে না। তাই আর সময় নষ্ট না করে রাহুলের উচিত, দ্রুত দলকে সংগঠিত করার দিকে নজর দেওয়া।
কানহাইয়া অত্যন্ত সঠিক কথা বলেছেন। সর্বভারতীয় দল হিসেবে বিজেপির সঙ্গে একমাত্র কংগ্রেসই টক্কর দিতে পারে। কারণ, দেশের সব রাজ্যেই কংগ্রেসের অস্তিত্ব রয়েছে। কংগ্রেস দুর্বল হয়ে পড়লে, ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে তা মোটেই সুখকর হবে না।
ভারতে এখন আঞ্চলিক দলের সংখ্যা কম নয়। সব দলকে একমঞ্চে আনা অত্যন্ত কঠিন কাজ। একমাত্র কংগ্রেসই পারে ডান-বাম সবপক্ষের নেতাদের নিয়ে গ্রহণযোগ্য জোট গড়ে তুলতে। যতদিন না তা সম্ভব হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত বিজেপিকে চাপে ফেলা কঠিন হবে। কানহাইয়াদের মতো নেতাদের তুলে আনার পাশাপাশি রাহুলের উচিত দলের প্রবীণ নেতাদেরও উপযুক্ত গুরুত্ব ও সম্মান দেওয়া।
যে ২৩ জন দলে দক্ষ নেতৃত্ব গড়ে তোলার দাবি জানিয়ে সোনিয়া গান্ধীর কাছে চিঠি দিয়েছিলেন তাঁদেরও পরামর্শ নেওয়া উচিত রাহুল-সোনিয়ার। জন্মলগ্ন থেকেই কংগ্রেসে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রয়েছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু কংগ্রেস দুর্বল হয়ে পড়লে, ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে তা মোটেই সুখকর হবে না।