ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার
বাচ্চাদের চশমার গুরুত্ব বড়দের চাইতে অনেক বেশি। বড়রা যদি চশমা ব্যবহার না করেন, যদি চশমা ঠিক মত বানানো না হয় বা যদি পাওয়ারের ত্রুটি হয়ে থাকে তাহলে মাথাধরা, ঝাপসা দেখা ইত্যাদি কিছু সাময়িক সমস্যা হতে পারে, যা সহজেই সমাধান করা যায়। কিন্তু প্রয়োজন হলেও যদি বাচ্চাদের চশমা পরাতে না চান, যদি পাওয়ার সঠিক না হয় বা সময়মত পাওয়ার বদল না করা হয়, তাহলে দৃষ্টির স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, যা পরবর্তীকালে আর সংশোধন করা সম্ভব নয়।
জন্মের পরে 10-11 বছর বয়স পর্যন্ত সময় লাগে শিশুদের চোখের গঠন ও দৃষ্টির পূর্ণতা পেতে। দৃষ্টির কোনো ত্রুটি থাকলে সেই সময়ের ভিতরেই চিকিৎসা শুরু করা দরকার। পাওয়ার ছাড়াও জন্মগত ছানি, ট্যারা চোখ ইত্যাদি নিয়েও শিশু জন্মগ্রহণ করতে পারে। দুর্ভাগ্যক্রমে শিশুদের চোখের সমস্যা বা তার চশমা লাগবে কিনা অনেক সময়ই তা সহজে বোঝা যায় না। ফলে চিকিৎসা শুরু করতে অহেতুক দেরি হয়ে যায়। এই দেরির মাসুল তাকে সারাজীবন ভোগ করতে হতে পারে। এজন্য প্রত্যেক শিশুর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একবার ভালোভাবে চোখ পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
কী দেখে বুঝবেন আপনার বাচ্চার চশমা লাগতে পারে?
** চোখের কাছে নিয়ে বই পড়া বা টিভির খুব সামনে গিয়ে বসা।
** এক চোখ বন্ধ করে বই পড়া বা টিভি দেখা।
** পড়বার সময় লাইনের উপরে আঙ্গুল রাখা।
** চোখ কুঁচকে তাকানো। চোখের ট্যারা ভাব।
** ঘাড় কাত করে পড়বার চেষ্টা।
** বার বার চোখ রগড়ানো, চোখ থেকে জল পড়া।
** আলোর দিকে তাকাতে কষ্ট।
** মাথা ব্যথা বা চোখের ক্লান্তি।
** দেখবার সময় বাচ্চার চোখ যদি কাঁপতে (Nystagmus) থাকে।
** বাইরে খেলাধুলা করতে না যাওয়া, পড়াশুনো বা হোমওয়ার্ক করতে অনীহা।
** পড়াশোনায় অমনোযোগ, পরীক্ষার খারাপ রেজাল্ট ।
বাচ্চাদের চোখ পরীক্ষা করা বা চোখের পাওয়ার ঠিক করা খুব সহজ কাজ নয়। প্রথমত তারা চঞ্চল, ডাক্তারের নির্দেশ অনেক সময় বুঝতে পারে না। অনেকের অক্ষরজ্ঞান তখনো হয়নি অথবা ভয় বা লজ্জায় চুপ করে থাকে। অনেক ধৈর্য আর সময় নিয়ে এইসব বাচ্চাদের চোখ পরীক্ষা করতে হয়। বড়দের মত একদিনেই পাওয়ার দেওয়া যায় না বলে বাচ্চাদের একাধিকবার চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হতে পারে।
বাচ্চাদের চোখের পাওয়ার কিভাবে দেওয়া হয়
ডাক্তারবাবুর নির্দেশমত অ্যাট্রোপিন মলম বা হোমাট্রোপিন ড্রপ দিয়ে বাচ্চাদের চোখের Pupil কে বড় (Dilate) করে, রেটিনোস্কোপি পরীক্ষার পরে Objective Refraction পদ্ধতিতে বাচ্চাদের পাওয়ার নির্নয় করা হয়। অ্যাট্রোপিন মলম বাড়ি থেকে লাগিয়ে আসতে (দুচোখে দুবার করে ৩ দিন) হয়। বাচ্চাদের চোখের Pupil বড় হতে অনেক সময় লাগে বলে হোমাট্রোপিন ড্রপও বাড়ি থকে লাগিয়ে (আধ ঘণ্টা বাদে বাদে দুচোখে ৬বার) আসাই ভালো।
ছোটো শিশু কিম্বা যেসব বাচ্চারা পড়তে পারে না, রেটিনোস্কোপি পরীক্ষার পরেই তাদের পাওয়ার দেওয়া যায়। যারা স্নেলেনস চার্ট (চোখের ডাক্তারের চেম্বারে চোখের দৃষ্টি পরীক্ষা করবার চার্ট) পড়তে পারবে, তাদের 1-3 সপ্তাহ পরে (অর্থাৎ চোখের Pupil স্বাভাবিক হলে) Subjective Refraction পদ্ধতিতে পাওয়ার স্থির করা হয়।
অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের চশমা দেওয়া পছন্দ করেন না। তারা চান কোনো আইড্রপ বা ভিটামিনের সাহায্যে চোখ ভালো করতে। মনে রাখা দরকার আইড্রপ বা ভিটামিনের সাহায্যে চোখের পাওয়ারের চিকিৎসা করা যায় না। বাচ্চার যদি চশমার প্রয়োজন হয় তবে তা পরতেই হবে, নতুবা দৃষ্টির পুরোপুরি বিকাশ হবে না।
অনেক সময় বাচ্চাদের দুচোখে দুরকমের পাওয়ার থাকে। এই পার্থক্য খুব বেশি হলে চশমার বদলে কন্টাক্ট লেন্স পরবার দরকার হয়। বর্তমানের অত্যন্ত উন্নতমানের কন্টাক্ট লেন্সগুলি বাচ্চাদের জন্য যথেষ্ট নিরাপদ। কখনো কখনো দেখা যায় বাচ্চার একচোখ ঠিক থাকলেও অন্য চোখের দৃষ্টি খুবই ক্ষীণ। এটি অ্যামব্লায়োপিয়া বা Lazy Eye-এর লক্ষ্মণ। এক্ষেত্রে চশমার সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের চোখের ব্যায়ামেরও প্রয়োজন হয়।
শুধু চশমা নিলেই সমস্যার সমাধান হয় না। ডাক্তারের নির্দেশমত চশমাটা পরতে হবে। শরীরের গঠন বৃদ্ধির সাথে সাথে বাচ্চাদের চোখের পাওয়ারও বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তাই 6 মাস বা একবছর অন্তর চশমার পাওয়ার নতুন করে পরীক্ষা করে নিতে হয়। এছাড়াও পাঠ্যবস্তু ও পারিপার্শিক আলোর উজ্জ্বলতার দিকে নজর রাখতে হবে। বাচ্চারা প্রথম প্রথম চশমা পরতে চায় না বা ভুলে যায়। বাবা-মার সেদিকে খেয়াল রেখে চশমার প্রয়োজনীয়তা বাচ্চাদের বুঝিয়ে বলা দরকার। এছাড়া ফ্রেম ও লেন্সের যত্ন নেওয়ার বিষয়টাও তাদের শিখিয়ে দেওয়া জরুরি। তবে এটাও ঠিক যে রঙ এবং ডিজাইন বাচ্চাদের পছন্দ না হলে তারা চশমা পরতে চাইবে না।
বাচ্চাদের চশমা বানানো সহজ কথা নয়। ফ্রেম নির্বাচনে তাদের পছন্দের যেমন গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি অভিভাবকেরও অনেক কিছু জিনিস খেয়াল রাখা দরকার। ফ্রেমের রঙ আর ডিজাইন তাদের পছন্দ মত না হলে বাচ্চারা চশমা পরতে চাইবে না। কিন্তু চশমা তৈরির সময় তার আকার, ফিটিংস, লেন্সের উপাদান, বাচ্চার স্বভাব অর্থাৎ সে শান্ত না ছটফটে ইত্যাদি খুঁটিনাটির দিকেও নজর রাখতে হবে।
শখের চশমা
বাচ্চাদের কল্পনার জগত আকাশের মতই সীমাহীন। অনেক সময় তাদের মনে নানা শখের উদয় হয়। স্কুলের বন্ধু, পরিবারের সদস্য বা টিভির প্রিয় কার্টুনকে দেখে তারও চশমা পরতে ইচ্ছে করে। চোখে কোনো অসুখ না থাকলেও বাবামাকে তারা নানা অভিযোগ জানাতেই থাকে। যেমন তার নাকি দেখতে অসুবিধা, মাথাব্যাথা বা চোখ টনটন করছে। এখুনি চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
রেটিনোস্কোপি পরীক্ষার পরেই বাচ্চাদের চশমার পাওয়ার দেওয়া উচিত
বাচ্চার চশমা কতক্ষণ পরে থাকতে হবে, সেটা আপনার চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিন।
চশমাটি হতে হবে হালকা, মজবুত আর টেঁকসই
বাচ্চাদের চশমায় কাঁচের লেন্স একেবারেই নয়।
চশমার ফিটিং ঠিক না হলে বাচ্চাদের চোখের ক্ষতি হতে পারে। প্রতি ৬ মাস বা এক বছর অন্তর চশমার পাওয়ার বদলিয়ে নেওয়া দরকার।