হোমঅন্যান্যকলকাতা থেকে জেলা, বাংলাজুড়ে ঐতিহ্যের ঝুলন উৎসব

কলকাতা থেকে জেলা, বাংলাজুড়ে ঐতিহ্যের ঝুলন উৎসব

কলকাতা থেকে জেলা, বাংলাজুড়ে ঐতিহ্যের ঝুলন উৎসব

শুভদীপ রায় চৌধুরী
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মধ্যে ঝুলন উৎসবের মাহাত্ম্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মথুরা-বৃন্দাবনের মতনই বঙ্গের ঝুলন উৎসব সুপ্রাচীন। কেবলমাত্র রাধাকৃষ্ণের যুগলবিগ্রহ দোলনায় রেখে নানান আচার অনুষ্ঠানই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার সাংস্কৃতিক গৌরব।  শ্রাবণের শুক্লা একাদশী থেকে পূর্ণিমা অবধি চলে এই উৎসব।

উৎসব হয় মূলত বনেদিবাড়ি কিংবা কৃষ্ণ মন্দিরে। তবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি কচিকাঁচাদের ঝুলন সাজানোর আকর্ষণ হারিয়ে যায়নি। আজও অনেক জায়গায় মাটির পুতুল, কাঠের দোলনা এবং গাছপালা দিয়ে ঝুলন সাজানো হয়।

কলকাতায় ঝুলন বলতে যাদের নাম সবার প্রথমে আসে, তা হল উত্তর কলকাতার  ‘ঝুলনবাড়ি’।  বউবাজারের রামকানাই অধিকারীর বাড়ি। প্রায় ২০০ বছর আগে এই পরিবারের আদিপুরুষ কৃষ্ণমোহন অধিকারী এই ঝুলন উৎসব শুরু করেন। পরবর্তীকালে  তাঁর পৌত্র রামকানাই অধিকারীর সময় এই উৎসবের জাঁকজমক আরও বৃদ্ধি পায়। এ বাড়ির রাধাবল্লভ জিউর ঝুলন উৎসব দেখতে আজও হাজির হন বহু মানুষ।

এ বাড়িতে ঝুলন হয় পাঁচ দিন ধরে। আর এই পাঁচ দিনে দেবতাকে নানা বেশে সাজানো হয়। প্রথম দিন রাখাল বেশ, দ্বিতীয় দিন যোগী বেশ, তৃতীয় দিনে সুবল বেশ, চতুর্থ দিনে হয় কোটাল বেশ এবং শেষ অর্থাৎ পঞ্চম দিনে রাজ বেশ।

প্রথম দিনে হোম সম্পন্ন করে উৎসবের সূচনা করা হয়। এর পরে দেবতাকে এক এক দিন এক এক রকমের ভোগ নিবেদন করা হয় ঝুলন বাড়িতে।

এর পাশাপাশি, উত্তর কলকাতার চালতাবাগান অঞ্চলে বঙ্কুবিহারী সাহা প্রতিষ্ঠিত রাধাকৃষ্ণের ঝুলন মন্দিরে এই উৎসব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই উপলক্ষে বিশেষ ভোগ নিবেদনও করা হয়। মন্দির চত্বরে ছোট ছোট ঘরগুলির মধ্যে কৃষ্ণলীলা এবং মহাভারতের ঘটনাগুলি মাটির পুতুল দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়। এছাড়া, ওই পথেই মণ্ডল বাড়ির রাধাকৃষ্ণ জিউর মন্দিরেও ঝুলন উৎসব হয়। একাদশী থেকে দ্বিতীয়া অবধি মোট সাত দিন ধরে চলে এই উৎসব। প্রথম দিন রাধাকৃষ্ণের যুগল বেশ, দ্বিতীয় দিনে অনন্ত দর্শন, তৃতীয় দিনে রাসলীলা, চতুর্থ দিনে নৌকাবিলাস, পঞ্চম দিনে চন্দ্রাবলীকুঞ্জ, ষষ্ঠ দিনে রাইরাজা এবং সপ্তম অর্থাৎ শেষ দিনে মিলন বেশ। বলাবাহুল্য, এই উৎসব উপলক্ষে প্রতিদিনই লুচি, মালপোয়া, সুজি ইত্যাদি দেবতাকে নিবেদন করা হয়, বসে জমজমাট মেলা। 

উত্তর কলকাতার পাশাপাশি দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জে বাওয়ালির মণ্ডল পরিবারের উদয়নারায়ণ মণ্ডল প্রতিষ্ঠিত মদনমোহন জিউর মন্দিরে ( বড় রাসবাড়ি নামে পরিচিত), আজও ঝুলন উৎসব হয়। তিন দিন ধরে চলে এই উৎসব। এই তিনটি দিন ভোরবেলায় দেবতাকে ডাবের জল দিয়ে স্নান করিয়ে নতুন সাজে সাজানো হয়। ঝুলন উপলক্ষে হয় নামসংকীর্তনও। প্রতি দিন ২৫-৩০ রকমের ফলের নৈবেদ্য, লুচি, সুজি যুগলকে নিবেদন করা হয়।

কলকাতার পাশাপাশি জেলাতেও , ঝুলন উৎসবের মাহাত্ম্য বেশ প্রাচীন। তার মধ্যে খড়দহের শ্যামসুন্দরের ঝুলন, শ্রীরামপুরের রাধাবল্লভের ঝুলন কিংবা পানিহাটির রাধাগোবিন্দ বাড়ির ঝুলন দেখতে আজও দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন। তেমনই শান্তিপুরের বড়গোস্বামী বাড়িতে শ্রী রাধারমনের ঝুলনযাত্রা, যা বহু প্রাচীন। বড় গোস্বামী বাড়িতে উৎসব চলে তিনদিন ধরে। এক এক দিন দেবতাকে নানান ধরনের বেশ পরানো হয়। আর মূল পুজোটি হয় পূর্ণিমার দিনে। সে দিন মন্দিরে ভাগবত পাঠ হয়, নিবেদন করা হয় বিশেষ অন্নভোগ। বড়গোস্বামী ছাড়াও শ্যামচাঁদ মন্দির, গোকুলচাঁদ মন্দিরে সহ বহু বৈষ্ণব ক্ষেত্রে এই উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়ে থাকে। কিছু কিছু জায়গায় হয় পুতুল ঝুলন। এখানে নানা ধরনের পুতুল দিয়েও ঝুলন সাজানো হয়।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img