দেবস্মিতা নাগ
বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ঠিক কী কী হতো নববর্ষে? কেমন করে বছরের প্রথম দিনটাকে নিজে হাতে সাজাতেন রবীন্দ্রনাথ? তাঁকে ঘিরে আর কে কে থাকতেন? সবশেষে কেমন হতো নতুন বছরের প্রথম মধ্যাহ্নভোজনের পাত? এসব কৌতূহল সবার মনেই কম বেশি হয়। সেই সব কৌতুহল মেটাতেই আজ অতীতের পথে কয়েক পা হাঁটবো।
পয়লা বৈশাখের উৎসব উদযাপন কিন্তু প্রথম এই ঠাকুরবাড়িতেই শুরু হয়। পরে ধীরে ধীরে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। বাংলায় পয়লা বৈশাখ তাই কেবল মাত্র হালখাতা নয়, সাংস্কৃতিক জোয়ারে বছরের প্রথম ঢেউ।
চৈত্রের শুরু থেকেই ঠাকুরবাড়ির ছাদে অথবা অবনীন্দ্রনাথের দোতলার ঘরে শতরঞ্চি পেতে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের মহড়া শুরু হয়ে যেত।রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা গান, কবিতা, নাটক, গানের সঙ্গে নৃত্য প্রভৃতির রেওয়াজ চলত নিয়ম করে। সঙ্গে থাকতেন দীনেন্দ্রনাথ, ইন্দিরাদেবী, নলিনী দেবী, মনীষা দেবী, অবনীন্দ্রনাথের কন্যা সুরূপা, গগনেন্দ্রনাথের কন্যা হাসিদেবী প্রমুখেরা।
নববর্ষের খাওয়াদাওয়া হতো দোতলার টানা বারান্দায়। খাদ্য নিয়ে ঠাকুরবাড়ির বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথের পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা কমবেশি সবাই জানেন। নববর্ষের পাতেও সেসব গবেষণার ছায়াপাত হতো। একবার নববর্ষে মৃণালিনী দেবী জনপ্রিয় মিষ্টি “এলোঝেলো” বানিয়েছিলেন। কবির সে মিষ্টি পছন্দ হলেও নামটা পছন্দ হয়নি। উনি নাম পাল্টে রাখলেন “পরিবন্ধ”। মৃণালিনী দেবীর সেই বিখ্যাত কচুর জিলিপি ্ও এক নববর্ষেরই গবেষণাপ্রসূত।
এই দিনে এমন কিছু পদ রান্না হত, যেগুলিকে এক কথায় প্রত্নপাক বলা চলে। যেমন, এঁচোড় ও মুসুরির ডাল বেটে বড়া করে তার রসকদম্ব। এই পদটি সমস্ত অনুষ্ঠানে প্রজ্ঞাসুন্দরী গুরুদেবকে রেঁধে খাওয়াতেন।সেদিন কিছু সাবেকি রান্নাও হতো। যেমন, ছোলা ও ইলিশের মাথা দিয়ে কচুশাক, কাসুন্দি দিয়ে পাটপাতার ঝোল, ডুমুরের রসা, পুঁই মিটুলির চচ্চড়ি, মসুর ডালের বড়া, মোচাঘন্ট, লাউডগা দিয়ে মটর ডাল, সজনে শাক প্রভৃতি।
শেষ পাতে থাকতো এক অতি বিচিত্র খাদ্য, পাঁঠার হাড়ের অম্বল। এটি আবার দ্বিজেন্দ্রনাথের ভীষণ পছন্দের পদ ছিল। আমিষ পদের মধ্যে এমন কিছু থাকতো, যা আজ বাঙালির হেঁসেলের জাদুঘরে ঠাঁই পেতে পারে, যেমন- আম শোল, মাছের পোলাও, চিতল আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল, কাঁচা ইলিশের ঝোল। আবার নারকেল চিংড়ির মত কালজয়ী পদও থাকতো।
চৈত্র সংক্রান্তির শেষ লগ্নে নববর্ষের সূর্যাস্তের আগে ঘটে আতপ চাল ভিজিয়ে তাতে কচিপাতাযুক্ত আমডাল ডুবিয়ে রাখা হতো। পরদিন পরিবারের সবাইকে সেই ভেজানো চাল খাওয়ানো হতো এবং সেই আমডাল দিয়ে জল ছিটিয়ে সারা বাড়িতে ও সকলের গায়ে দেওয়া হতো। এরপর সকলের কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে জলখাবার দেওয়া হতো। জল খাবারে থাকতো নুন আর আদাকুচি দিয়ে মাখা ভিজে মুগডাল, নুন লেবু দিয়ে মাখা শসা নারকেল, কাঁঠালি কলা, দই-মিষ্টি ইত্যাদি।
একদিন শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে নববর্ষের ভাষণ শেষে প্রবল কালবৈশাখী ধেয়ে এসেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঝোড়ো হাওয়ায় ভিজতে ভিজতে গেয়ে উঠেছিলেন, “তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে”।
এই ছিল স্বাদে, গন্ধে, বর্ণে, নিক্কনে, সুরমূর্ছনায় হর্ষগীত-উচ্ছ্বসিত ঠাকুরবাড়ির পয়লা বৈশাখ। সেই সুর, সেই স্বাদ, সেই গন্ধ আজও বাংলার নতুন বছরের বাতাসে ফিরে ফিরে আসে বেলফুলের সাজিতে, তালপাতার হাতপাখায়।