হোমPlot1এগিয়ে আসছে মহালয়া, ডোমপাড়ায় শিল্পকর্মের জোরদার লড়াই

এগিয়ে আসছে মহালয়া, ডোমপাড়ায় শিল্পকর্মের জোরদার লড়াই

এগিয়ে আসছে মহালয়া, ডোমপাড়ায় শিল্পকর্মের জোরদার লড়াই

অশোক সেনগুপ্ত
গিরীশ পার্ক মেট্রো স্টেশনের ঢিলছোঁড়া দূরত্বে ডোমপাড়া। প্রশস্ত চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের ধারে অনেকটা অংশ জুড়ে সারিবদ্ধ কারিগররা কাজে মগ্ন। ভাদ্রমাস শেষ না হতেই ওঁরা মহাব্যস্ত। কারণ পুজো এবার আশ্বিনের প্রথমার্ধে। মণ্ডপের কাজ মহালয়ার আগে শেষ করতে চান উদ্যোক্তারা। মণ্ডপের প্রতিযোগিতা মানে ভাবনা এবং শিল্পকর্মের নিরিখে কে, কত দেখনাই করতে পারে, তার লড়াই। এসবের মূল কেন্দ্রবিন্দু হল এই ডোমপাড়া।

কেবল মূল রাস্তা নয়, সংলগ্ন অদ্বৈত মল্লিক লেন অবরুদ্ধ। কোনওক্রমে এঁকেবেঁকে হেঁটে যাওয়া যাবে মাত্র। গোটা রাস্তা জুড়ে চলছে শিল্পচর্চা। কেউ বড় বড় থার্মোকলের পাত ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে নকশা করছে। কেউ কেউ তৈরি করছেন নানা ধরনের মোটিফ। কেউ বসেছেন এক বালতি আঠা নিয়ে। কঞ্চির নানা আদলের কাঠামোয় সাঁটছেন মোটা কাগজ। ওই কাগজের ওপর বসবে রংবেরংয়ের কাপড়, রাংতা প্রভৃতি। এ সবই ব্যবহৃত হবে মণ্ডপসজ্জায়।

বড়রাস্তার ওপরে এক মাঝবয়সী মন দিয়ে পদ্মফুলের কাঠামো তৈরি করছেন। সামনে গিয়ে মন দিয়ে কিছুক্ষণ দেখলাম। নাম জনতে চাওয়ায় বললেন।, “আমি তুলসি”। শুধালাম, পুরো নাম কী? বললেন, “ওই তুলসিই। পুরো নাম নাম তুলসিচরণ কাটারি। ও নামে কেউ চিনবে না।” নমনীয় সরু, শক্ত — নানা ধরনের, হরেক মাপের কঞ্চি দিয়ে হচ্ছে সেই কাঠামো। তৈরি করতে তিন দিন লাগবে। আড়াই ফুট উঁচু এবং চার ফুট ব্যাসের ওই কাঠামো তৈরি-বাবদ তুলসি পাবেন আড়াই হাজার টাকা। এর পর সেটি যাবে আর এক কারিগরের কাছে। কাগজ বসিয়ে আনা হবে ফুলের আদল। তার পর আরেকজনের কাছে। তার পরে আরও একজন। সাজসম্পূর্ণ সেই ফুল দেখে চিত্রার্পিতের মত মন ভরে দেখবেন না, এমন লোক ক’জন আছেন?

প্রশ্নের উত্তরে জানলাম, বাবাও ছিলেন ডোমপাড়ার কারিগর। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন তুলসি। আর মানব হলেন ঠিকাদার। মানব বাবা কালীনাথ বাগের হাত ধরেই কাজ শিখেছেন প্রায় তিন দশক আগে। জানালেন, অন্তত ৫০টি পুজোর দেবীর চালচিত্র তৈরির দায়িত্ব তাঁর হাতে। নিজে করেন না, করান।

মানবের স্পেশালাইজেশন এই চালচিত্র— দুর্গা প্রতিমার উপরে অর্ধগোলাকৃতি একটি বিশেষ পটচিত্র, যাতে দেবদেবীর কাহিনী অঙ্কিত। এতে পঞ্চানন শিব, মহিষাসুর বধ, নন্দীভৃঙ্গীর যুদ্ধ, শুম্ভ-নিশুম্ভের লড়াই ইত্যাদি দেবদেবীর কাহিনি ফুটিয়ে তোলা হয়। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকলা প্রতিমার পটভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 

মানব জানান, চার পর্যায়ে হয় এক একটা চালচিত্র। প্রতিটি চালচিত্রে প্রতি পর্যায়ের কারিগরকে দিতে হয় এক হাজার টাকা করে। প্রতিটি চালচিত্রে সরঞ্জাম লাগে হাজার দুই টাকা। প্রতিমাশিল্পী কেনেন হয়তো বড়জোর ১০ হাজার টাকায়। শেষমেষ চালচিত্র-পিছু লাভ থাকে বড়জোর হাজার চার টাকা।

মানবের অন্যতম কারিগর রমেন্দ্রনাথ ঘাটি। স্কুলজীবন থেকেই চালচিত্র তৈরিতে যুক্ত। বহু বছর হয়ে গেল এই পেশায়। ভয় কিসে? আকাশের দিকে তাকিয়ে রমেন্দ্রনাথ বললেন, “ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিটি পর্যায়ের কাজ হয়। ভয় হলো বৃষ্টি! কখন যে ঝপাং করে নেমে সব ভিজিয়ে দেয়! এই তো দেখছেন না, কত সব প্লাস্টিকের চাদরে ঢেকে রেখেছি!”

অদ্বৈত মল্লিক লেনে বাবু নামে এক কারিগর কঞ্চি দিয়ে ডাবের কাঠামো তৈরিতে ব্যস্ত। প্রায় চার ফুট লম্বা ওই ডাব বসবে ১০ ফুট উঁচু ঘটের ওপর। ঘটও তৈরি হবে কঞ্চি দিয়ে। বসবে বরানগর থানার পিছনে পোল্যান্ড ক্লাবের মণ্ডপে। মিঠুন মাইতির ব্যস্ততা প্রায় ১৪ ফুট উঁচু স্ফিংস তৈরি করানো নিয়ে। কঞ্চির ফ্রেমে নয়, থার্মোকলের বড় বড় মণ্ড কেটে তিন ভাগে তৈরি হচ্ছে সেই স্ফিংস। মণ্ডপে মিশরের আবহ তৈরির চেষ্টায় থার্মোকল কেটে তৈরি হচ্ছে আটটি প্যানেলের শিল্পকর্ম। এক একটি প্যানেল আট ফুট বাই চার ফুট।

হাতে গোনা কয়েকটা দিন। তারপর মহালয়া। কোনও ক্ষেত্রে ডেকোরেটর, কোনও ক্ষেত্রে প্রতিমাশিল্পী এসে নিজের প্রয়োজনের বরাত দিয়ে গিয়েছেন ডোমপাড়ায়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেসব তৈরি করে পৌঁছিয়ে দিতে হবে নির্দিষ্ট স্থানে। প্রতি বছর এভাবেই পুজোয় সামগ্রিক ভূমিকা নিয়ে থাকে ডোমপাড়া। এভাবেই এই সময়টায় এই তল্লাটে বেজায় ব্যস্ততা।

শারদোৎসবে কত টাকার ব্যবসা হয় এখানে? এক শিল্পীর চটজলদি হিসাব, “কোটি টাকার ওপর। দেখছেন না কত লোক কত রকম কাজ করছে”! প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে কত শ্রমিক-ঠিকাদারের রুজির সংস্থান করে এই ডোমপাড়া, তার হিসেব কে রাখেন? কারণ নিজস্ব কোনও সংগঠন নেই। সমীক্ষাও হয়নি এসব নিয়ে।

যুগ যুগ ধরে মধ্য কলকাতার এই তল্লাট শারদোৎসবে প্রাণসঞ্চার করে আসছে। তার মধ্যেই ক্ষোভ-খেদ— “জানেন, যে টাকায় প্রাথমিক রফার পর কাজ শুরু করি, সেই টাকা আমরা পাই না! তখন কত রকম অজুহাত! জিনিসপত্র কিনে, এত সময় ধরে, ভাবনার পরশে যে এই সব শিল্পকর্ম করছি, তার কোনও দাম নেই?”

(লেখক বর্ষীয়ান সাংবাদিক)

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img