দেবস্মিতা নাগ
লালমোহনবাবু চলেছেন ফেলুদার বাড়ি আড্ডা দিতে। আসর জমানোর জন্যে সঙ্গে রয়েছে এক হাঁড়ি নকুড়ের কড়া পাক। দৃশ্যটা সব বাঙালির কাছেই খুবই পরিচিত। হেদুয়ার বেথুন কলেজের কাছে, ৫৬ নম্বর রামদুলাল সরকার স্ট্রিটের গিরীশ চন্দ্র দে (Girish Chandra Dey)ও নকুড় চন্দ্র নন্দীর (Nakur Chandra Nandi) ১৭৭ বছরের দোকানের মিষ্টি আজ একটা সর্বভারতীয় ব্র্যান্ড। নকুড়ের জলভরা সন্দেশ বাঙালির অস্মিতা।
অনেক ইতিহাস দেখেছে এই দোকান। রসনাতৃপ্ত করেছে বহু নামী দামী মানুষের। ইতিহাসের নানা কাহিনী বাদ দিলেও, সাম্প্রতিক কালের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার সাক্ষী হয়েছে এই দোকানের মিষ্টি। বিগ বি তনয় অভিষেক বচ্চনের বিয়েতে মিষ্টিমুখের দায়িত্বে ছিল এই দোকানের পারিজাত, চকলেট সন্দেশ ও মৌসুমি সন্দেশ।
মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টনকে (Hilary Clinton) মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) এই দোকানের ১০০টি পারিজাত ও ১০০টি কাঁচাগোল্লা দিয়ে আপ্যায়ন করেন। IPL-এ যে বার KKR বিজয়ী হয়, মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালের উপস্থিতিতে ইডেন গার্ডেন্সের বিজয়ৎসবে ৩৪ কেজি ওজনের যে সন্দেশ কেকটি শাহরুখ কাটেন, তার নির্মাতাও এই দোকানের।
১৯ শতকের গোড়ায় বাংলার নবজাগরণের মতোই নকুড়ের মিষ্টিও সারা ভারতের সামনে বাংলার এক স্বতন্ত্র স্বাদের সংজ্ঞা নিয়ে আসে। এর পিছনে নকুড় চন্দ্রের (Nakur Chandra) নাতনী, অনুকূল নন্দীর কন্যা আশা দেবীর ভূমিকা অনেকটা। অনুকূলের মৃত্যুর পর দোকানের দায়িত্বে ছিলেন তাঁর ছেলে পরেশ। কিন্তু ১৯৬২ সালে মাত্র ৪১ বছর বয়সে ৪ নাবালক সন্তানকে রেখে মারা যান তিনি। ঠিক সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন ছানার ব্যবসা বন্ধ করে দেন।
প্রায় দেড় বছর টানা তালা ঝোলে দোকানে। প্রয়াত পরেশ বাবুর বিধবা স্ত্রী ছিলেন ভীম নাগের বাড়ির কন্যা। ভীম নাগের বাড়ি থেকে উপদেশ আসে দোকান বেচে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু পরেশবাবুর বোন আশা দেবী তখন শক্ত হাতে হাল ধরেন দোকানের। পুরোনো কর্মচারীদের আন্তরিক সহযোগিতায় উঠে দাঁড়ালো দোকান। এই দোকানের ইতিহাসের অনেকটাই এক নারীর একার ও তাঁর ভাইপোর লড়াই। তিনি তাঁর স্বামীর থেকেও কোনও সহযোগিতা পাননি। উপরন্তু তাঁর উপর ছিল একটি কন্যার ভার। সেইসঙ্গে ছিল শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ভীম নাগ।
দোকানের কাউন্টারের চারদিকে সবুজ গ্রিল দিয়ে ঘেরা। নকশাল আমল থেকে রয়েছে এই সুরক্ষা ব্যবস্থা। সে সময় দোকানে ডাকাতির চেষ্টা হয়েছিল।এই দোকানে আজও বসে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। দোকানে ছানা কেনা হয় না।রোজ দু বেলা হাজার লিটারের উপর দুধ দেন ৪ জন, দুজন দেন চিনি।বিরাট বিরাট বারকোষে সেই ছানা পাক দেন বিহার থেকে আনা সুদক্ষ কর্মী। একেক বারে ১০০ লিটার দুধ জাল দেওয়া হয়। দোকান গম গম করে জনা ২৫ কর্মচারীর কর্মব্যস্ততায়। সর্বক্ষণ চলতে থাকে নিত্যনতুন গবেষণা।
মিষ্টির ইতিহাসে যোগ হতে থাকে নতুন নতুন নাম-আম্রপালি, থ্রি স্টার। এদের সঙ্গে থাকে গোলাপি প্যাড়া, চন্দ্রপুলির মত সাবেকি মিঠাইরা।নতুন মিষ্টিতে যোগ হয়েছে আম, স্ট্রবেরি, ব্ল্যাক কারেন্ট, বাটার স্কচ আরও নানা কিছু। দোকানের মিষ্টির সংখ্যা এই মুহূর্তে দাঁড়িয়েছে ৬০। আরও নতুন নতুন গবেষণা চলছে। শুধু বাঙালি মহলেই নয়, অবাঙালীদের মধ্যেও ভীষণ জনপ্রিয় এই নকুড়ের মিষ্টি।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় শীতকালে নলেন গুড়ের চিরাচরিত মিষ্টি গুলোকেও নতুন করে সাজিয়েছেন কারিগররা। সেই কারণেই নকুড়ের সুখ্যাতি দিকে দিকে বেড়েই চলেছে। বাংলার মিষ্টি নকুড়ের হাত ধরে পৌঁছে যাচ্ছে দেশে দেশান্তরে।