দেবাস্মিতা নাগ
গোটা বাংলা যখন বারংবার বর্গী হামলায় জেরবার, তখন বর্ধমানের পাটুলী নিবাসী দত্তরায় পরিবারের জমিদার রামেশ্বর রায় ব্যান্ডেলের কাছে বংশবাটীতে এক বিরাট বাঁশ বন কেটে একটি পরিখা বেষ্ঠিত মজবুত দুর্গ তৈরি করেন। উদ্দেশ্য ছিল, বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া। তিনি ছিলেন স্বয়ং ঔরঙ্গজেবের স্নেহধন্য। ঔরঙ্গজেবকে তিনি বাংলায় রাজস্ব আদায়ে সাহায্য করতেন। দুর্গটিকে পাহারা দিত সশস্ত্র পাঠান সেনার দল।
আজও সেই দুর্গের ধ্বংসাবশেষকে স্থানীয়রা গড়বাটী বলে থাকেন। সেখানেই রামেশ্বর একটি টেরাকোটা খচিত অনন্ত বাসুদেব বিষ্ণু মন্দিরও নির্মাণ করেন। বর্তমানে মন্দিরটির অবস্থান হংসেশ্বরী মন্দিরের পূর্বে। পরবর্তীকালে রামেশ্বরের পুত্র রঘুদেব, রঘুদেবের পুত্র গোবিন্দ দেব, গোবিন্দ দেব আর হংসেশ্বরী দেবীর পুত্র তান্ত্রিক রাজা নৃসিংহদেব ১৮০২ সালে হংসেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ও তাঁর মাতার নামানুসারে এই মন্দিরের নামকরণ করেন।
পিতার মৃত্যুর তিন মাস পর জন্ম হয় নৃসিংহদেবের। সেই সুযোগে নবাব আলিবর্দী খান দত্তরায়দের সমস্ত সম্পত্তি হরণ করে নেন। রাজা নৃসিংহদেবকে সেজন্য শৈশবে খুবই দৈন্যের মধ্যে কাটাতে হয়। পলাশীর যুদ্ধের পর নৃসিংহদেব ওয়ারেন হেস্টিংসকে তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন করেন। হেস্টিংস নৃসিংহদেবকে ২৪টি পরগনা ফিরিয়ে দেন।তার পরেই নৃসিংহদেব মন্দির নির্মাণের কাজে হাত দেন।
প্রপিতামহের মন্দিরের ভগ্নদশা দেখে তিনি ঠিক করেন পাথরের মন্দির তৈরি করবেন। পাথর আসে ফাহানার থেকে আর জয়পুর থেকে নিয়ে আসা হয় সুদক্ষ কারিগরদের। নৃসিংহদেবের অকাল প্রয়াণে মন্দির নির্মাণের কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেলেও, পরে তাঁর স্ত্রী রাণী শঙ্করী আবার মন্দির নির্মাণ শুরু করেন এবং ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয় নির্মাণ। খরচ হয়েছিল তৎকালীন ৫ লক্ষ টাকা। ভিন্নমতে, এটিই বাংলার প্রাচীনতম মন্দির এবং এর আদি আরাধ্যা দেবী হলেন মহাযান বৌদ্ধ দেবী নীল তারা বা নীল সরস্বতী যিনি কালক্রমে হিন্দু রাজাদের আধিপত্যে আরাধ্যা দেবী কালী হিসেবে পূজিতা হন।
হংসেশ্বরী মন্দির বাংলার বুকে এক অনন্য প্রত্ন নিদর্শন। এর স্থাপত্যশৈলী অনবদ্য। স্থপতি মহলে এই মন্দিরের নির্মাণ কৌশলের বিশেষ সুখ্যাতি আছে। ৭০ ফুট উঁচু দক্ষিণমুখী এই মন্দিরটি বারাণসীর স্থাপত্য শিল্পের আদলে নির্মিত। পুরো মন্দিরটি ইট ও পাথর দিয়ে তৈরি। মন্দিরের চারদিকে খোলা বারান্দা এবং মন্দিরের সামনে বাঁধানো প্রশস্ত চত্বর আছে। এর গঠনপ্রণালীতে যৌগিক ষটচক্রভেদের সংকেত দেওয়া রয়েছে।
তন্ত্রমতে তৈরি এই পাঁচতলা মন্দিরের আটকোণে ৮টি, মাঝখানে ৪টি ও কেন্দ্রে ১টি, সবমিলিয়ে মোট ১৩টি পদ্ম কোরকাকৃতি চূড়া রয়েছে। মাঝখানের শৃঙ্গটির নীচের তলার প্রকোষ্ঠে একটি শ্বেতবর্ণ শিবলিঙ্গ রয়েছে। এই মন্দিরের পাঁচটি তলা নরদেহের ষটচক্রভেদের ইড়া, পিঙ্গলা, বজ্রাক্ষ, সুষুম্না ও চিত্রিনী নামে পাঁচটি নাড়ির প্রতীক এবং হংসেশ্বরী কুলকুন্ডলিনী রূপে সেখানে বিরাজ করছেন।
হংসেশ্বরী দেবীর মূর্তি নিমকাঠের তৈরি। দেবীর বর্ণ নীল। পঞ্চমুন্ডির বেদির উপর সহস্রদল পদ্মের মধ্যে শবরূপে শায়িত শিবের নাভি থেকে উঠে আসা দীর্ঘ মৃনালে ফোটা পদ্মের উপর দেবী হংসেশ্বরী বাঁ পা মুড়ে এবং ডান পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। মন্দিরের বহু কক্ষে বেশ কিছু শিবলিঙ্গ আছে।
এই মন্দিরে দেবীর শান্ত রূপের নিত্যপূজা হয়। তখন দেবীর পরনে থাকে রাজ বেশ। কিন্তু দেবীর প্রধান বাৎসরিক পুজো হয় কার্তিক অমাবস্যায় দীপান্বিতা তিথিতে। দীপান্বিতা অমাবস্যার সেই রাতে এলোকেশী রূপে পূজিতা হন দেবী। সেদিন কেবলমাত্র পুষ্পালঙ্কারে সজ্জিতা দেবীর মুখে পরানো থাকে রূপোর মুখোশ ও সোনার জিভ। সেই পূজা হয় তন্ত্র মতে। আর বছরের অন্যদিনগুলোতে দখিণা কালীকা মতে দেবীর পূজা হয়।
প্রতি ১২ বছরে একবার দেবীর অঙ্গরাগ করা হয়। মন্দিরে নিত্য পুজো ছাড়াও পুণ্য তিথিগুলিতে দেবীর বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মন্দির চত্বরে দেবীর নিত্যপূজার অন্নভোগ প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থা আছে। ভোগ পেতে গেলে দক্ষিণার বিনিময়ে সকাল ১০টার আগে সংগ্রহ করতে হয় কুপন। তবে মন্দিরটির স্থাপত্যই এর মূল আকর্ষণ।