ডঃ বিকাশ পাল, লন্ডন
১৯২৪ সাল। সে বছরের শুরু থেকেই কবি চিন, জাপান আর পূর্ব এশিয়ায় ভ্রমণ করছেন। সঙ্গে লিওনার্ড এল্মহার্স্ট। এমন সময় খবর এল পেরুর স্বাধীনতার শতবর্ষের উদযাপনে কবিকে সে দেশ রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণ পাঠিয়েছে। লিওনার্ড জাপান থেকে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখলেন, উদ্যোক্তারা প্রচ্ছন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, শান্তিনিকেতনের আশ্রমের উন্নতির জন্য ৫০ হাজার ডলার মত পাওয়া যেতে পারে। একইভাবে মেক্সিকো থেকেও আমন্ত্রণ আছে। বিশ্বভারতীর তহবিল তখন তলানিতে। লিওনার্ড ও রথীন্দ্রনাথ কবিকে প্রস্তাব দিলেন দক্ষিণ আমেরিকায় একটা লেকচার ট্যুর করার। কবি সম্মত হলেন।
জাপান থেকে শান্তিনিকেতনে ফিরেই তড়িঘড়ি করে ইউরোপ হয়ে পেরু যাওয়ার প্রস্তুতি শেষ হোল। কলম্বো থেকে সেপ্টেম্বর মাসেই হারুনা মারু জাহাজে কবি রওনা দিলেন, সঙ্গে রথীন্দ্রনাথ আর পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। প্রথমে প্যারিস। পুত্র ও পুত্রবধূ চললেন জার্মানি, অস্ট্রিয়া আর সুইজারল্যান্ডে। ইংল্যান্ড থেকে লিওনার্ড কবির সাথে যোগ দিলেন প্যারিসে। ফ্রান্স থেকে একসাথে ১৮ অক্টোবর আন্দেজ জাহাজে চড়ে বসলেন। গন্তব্য লিসবন, রিও ডি জেনেইরো, উরুগুয়ার মন্তেভিদেও হয়ে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ারস। প্রায় কুড়ি দিনের জাহাজের যাত্রা পথ। সেখানে কয়েক দিনের বিশ্রাম আর বুয়েনস এয়ারস বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতার অনুষ্ঠান।
তারপর প্রায় ১৫০ মাইল ট্রান্সআন্দিয়ান রেল পথে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগো। সেখান থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে জাহাজে পেরুর রাজধানী লিমা। আন্দিজের এই পাহাড়ি রেলপথে ভ্রমণ উপভোগ করার জন্য কবি মুখিয়ে আছেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, বিধাতা করেন আর এক। ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোতে কবির ঠাণ্ডা লেগে জ্বর আসতে শুরু করল। বছরের প্রায় পুরো সময়টাই কবি নানান দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ৬৩ বছরের শরীর আর নিতে পারছে না। জাহাজের কেবিনে একান্তে হেলান দিয়ে আর লেখালেখি করেই কবির কয়েকটা দিন কাটল। এভাবেই পূরবী কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা এই জাহাজের কেবিনে বসেই লেখা হয়েছিলো।
৬ নভেম্বর সন্ধে নাগাদ জাহাজ বুয়েনস আয়ারস পৌঁছল। সেখান থেকে কবি ও লিওনার্ড উঠলেন প্লাজা হোটেলে। পরের দিন কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা বিশেষ করে লা নাশান-এ কবির আগমন বার্তা রটে গেল। দুই ডাক্তারের একটি দল কবির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলেন। কবির ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরা পড়ল। তাই শরীর দুর্বল। ক্লান্ত কবির কয়েকদিন বিশ্রামের দরকার। ৮ নভেম্বর শনিবার হোটেলেই কবিকে বুয়েনস এয়ারসের সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে নাগরিক সম্বর্ধনার ব্যবস্থা করা হোল।
কবিকে দেখার জন্য প্লাজা হোটেলে উপস্থিত হয়েছেন শহরের অনেক অভিজাত মানুষ। তাঁদের মধ্যে সভাঘরে এসে পৌঁছেছেন বছর ৩০-৩৫ বয়সী এক লম্বা, ফর্সা , শিক্ষিতা এক অতি সুন্দরী মহিলা। নাম- রামোনা ভিক্টোরিয়া এপিফানিয়া রুফিনা ওকাম্পো। সংক্ষেপে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। সঙ্গে বান্ধবী অ্যাডেলিয়া। তাঁদের হাতে কিছু ফুল আর একটি কার্ড।
ভিক্টোরিয়া আর্জেন্টিনার খুব অভিজাত পরিবারের মেয়ে। প্রায় বছর ১০-১২ আগেই তাঁর বিয়ে হয়েছে , কিন্তু সে বিয়ে সুখের হয়নি। তবে তিনি তাঁর স্বামীর এক তুতো ভাই জুলিয়ান মার্টিনেজকে ভীষণ পছন্দ করেন, তাই তিনিই তখন তাঁর ভালবাসার মানুষ । যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি সেই সম্পর্ককে সিলমোহর দেননি। তাই বিগত ১০ বছর স্বামী মোনাকো এস্ট্রাদার সাথে সামাজিক বিবাহ-বিচ্ছেদেও যাননি।
ভিক্টোরিয়ার মাতৃভাষা স্পানিশ, কিন্তু ফ্রান্সের প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা করেছেন। তিনি ইংরেজি, স্প্যানিশের চাইতে ফরাসী ভাষাতেই বেশি সড়গড়। ১৯১৪ সালেই পড়েছেন গীতাঞ্জলির ফরাসী অনুবাদ। গীতাঞ্জলির কবিতার ভাবনাগুলিকে যে বিনম্রতা, আধ্যাত্মিক দার্শনিকতা আর বিশ্ববোধ চালিত করেছে, তা ভিক্টোরিয়ার চেতনাকে গভীর ভাবে স্পর্শ করেছে। এই কবিতার কবিকে তিনি তাই কবিতা পড়েই হৃদয় দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছেন।
ভিক্টোরিয়া গীতাঞ্জলি ছাড়াও, ঘরে বাইরে, ডাকঘর, চিত্রা, সাধনা – ইংরেজিতে এসব পড়ে ফেলেছেন গত দশ বছরে। দিনে দিনে গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে তাঁর রবীন্দ্রমুগ্ধতা। তাই সেদিন ফুলের স্তবকের সাথে যে কার্ড তিনি কবিকে পাঠিয়েছিলেন তাতে লেখা ছিল,
“My heart is aching, because, I have not found a single word to thank you. It will unburden me to send you flowers, because you know so well, they are not ‘merely colour and scent’ to us, but beauty and joy untrammelled by necessity.”
রবীন্দ্রনাথের অসামান্য ব্যক্তিত্বের সামনে এসে কবির প্রতি তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশের ভাষা তিনি খুঁজে পাননি। তবে সাধনায় ‘The Realisation in Love’ প্রবন্ধটি পড়ে তিনি যে অভিভূত, তা তাঁর এই কার্ডের বার্তাতেই পরিষ্কার।
কবির আপ্ত সহায়ক লিওনার্ড মারফত ফুল আর কার্ডটি কবির কাছে এসে পৌঁছল। সেদিনের সকলের সব শুভেচ্ছাবার্তার উত্তর এক এক করে কবি দেবেন ঠিক করেছিলেন। তবে সব পড়ে উত্তর দিতে অনেক সময় দরকার। তাই পরের দিন সে দেশের জাতীয় দৈনিকে সকলের উদ্দেশ্যে লিখলেন, তিনি প্রত্যেক শুভেচ্ছা প্রেরণকারীকেই লিখবেন, তাই এই বার্তা মারফত একটু সময় চেয়ে নিচ্ছেন।
ইনফ্লুয়েঞ্জা তখনও কবিকে কাবু করে রেখেছে। রেলযাত্রায় আন্দিজ পর্বতের চড়াই-উতরাইের ধকল কবির সহ্য হবে না। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বলেছেন, কবির সম্পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। সুতরাং পেরুতে এই মুহূর্তে যাওয়া সম্ভব নয়। কবি চিন্তিত আর কিছুটা পেরুর উদ্যোক্তাদের কাছে লজ্জিতও। কবির পক্ষে টানা হোটেলবাসও দুর্বিষহ। ডাক্তারি নির্দেশনামা ভিক্টোরিয়ার কানে পৌঁছল। অমনি তড়িঘড়ি করে বুয়েনস আয়ারসে পেরুর দূতাবাসে তিনি জানালেন, কবির বিশ্রামের ব্যবস্থা তিনিই করবেন।
শহরের উপকণ্ঠে এক অভিজাত এলাকা সান ইসিদ্রো। সেখানে মিরাল রিও নামে একটি সুন্দর বাড়ির ব্যবস্থা হোল। বাড়ির মালিক ভিক্টোরিয়ার বান্ধবীর স্বামী। খুব সম্ভবত ১২ নভেম্বর সেই বাড়িতে অসুস্থ কবি এসে উঠলেন। মিরাল রিও-র অর্থ রিভার ভিউ। বাড়ির বাগান গিয়ে মিশেছে রিও দে লা প্লাতা, মানে প্লাতা নদীতে। একেবারে শান্ত সুন্দর পরিবেশ, বাড়ির বারান্দায় বসে প্লাতার ধীর বিরামহীন প্রবাহ, প্লাতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত কোলাহলহীন জনজীবন, মাথার উপর রোদ ঝলমল নীল আকাশ আর নির্মল বাতাস। দক্ষিণ গোলার্ধে নভেম্বর মানে গরম কাল। লম্বা দিন। কবির রোগমুক্তির সহায়ক। মাঝে মাঝে কবি বাগানের পিপা গাছের তলায় বসেন। শিলাইদহের পদ্মাপারের মধুর স্মৃতি কবির মানসপটে ভেসে উঠে।
সব তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করে যতটুকু জানা যায়, ১৪-১৫ নভেম্বর নাগাদ কবির সময় হোল ভিক্টোরিয়ার কার্ডের বার্তার বিশদ উত্তর দেওয়ার। কবি লিখলেন-
“Last night when I offered you my thanks for what is ordinarily termed as hospitality, I hoped that you could feel that what I said was much less than what I meant.
It will be difficult for you to fully realise what an immense burden of loneliness I carry about me, the burden that has specially been imposed upon my life by sudden and extraordinary fame. I am like an unfortunate country where on an inauspicious day, a coal mine has been discovered with the results that its flowers are neglected, its forests cut down and it is laid bare to the pitiless gaze of a host of treasure seekers. My market price has risen high, and my personal value has been obscured. This value I seek to realise with an aching desire which constantly pursues me. This can be had only from a woman’s love, and I have been hoping for a long time that I deserve it.
I feel today that this precise gift has come to me from you and that you are able to prize me for what I am, and not for what I contain. This has made me so glad and yet I know that I have come to that period of my life when in my travel across a desert, I need my supply of water more than ever before but I neither have the means or strength to carry it and therefore can only thank my good fortune when it is offered to me and then take my leave “
– Sri Rabindranath Thakur
সত্যি সত্যি নোবেল পুরস্কার তাঁকে রাতারাতি জগদ্বিবখ্যাত করলেও, সহধর্মিণী মৃণালিনী দেবীর অকাল প্রয়াণের পর থেকেই তাঁর পরিবারে মৃত্যুমিছিল লেগেই ছিল। পিতা মহর্ষি আর তাঁর তিন সন্তান, রেনু, শমি ও বেলাকে পর পর হারিয়ে অন্তরে আরও তিনি নিঃসঙ্গ হয়েছেন।
কবির এই চিঠি পেয়ে পরের দিনই ভিক্টোরিয়া লিখেছিলেন এক লম্বা চিঠি:
San Isidro, 16 ? November 1924
This night
It is not for you to thank me. Whatever I do, it will always be for me to be thankful. You have given me so much, so much without even knowing it, that I will never be able to acquit myself.
এই চিঠিটি পাওয়ার প্রায় ১৫ বছর পরে কবি একটি গান লিখেছিলেন, “আমার জীবন পাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান, তুমি জানো নাই তার মূল্যের পরিমাণ”
ঠিক যেন ভিক্টোরিয়ার বক্তব্যের বাংলা তর্জমা। কার উদ্দেশে কবি লিখেছিলেন তাঁর বিদায় বেলায় জানি না। হয়তো যত মানুষের প্রীতি ভালোবাসা পেয়েছেন সারা জীবন, সেই মানুষ দেবতাদের কাছেই এই গানের মধ্য দিয়ে তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন।
ভিক্টোরিয়ার এই লম্বা চিঠিটির ছত্রে ছত্রে রয়েছে কবির প্রতি তাঁর মুগ্ধতা, তাঁর প্রেম ও তাঁর ভালোবাসা।
“Nothing that is you can be lost for me. Nothing that is you can not be taken away from me. While you stay here, joy will be with me; when you will go, pain must come. But at the very roots of my being nothing can be changed. Your staying or going can’t deprive me of you.
……
I should like to do something for you. But what can I do except loving you as I did before you came and as I’ll do after you’re gone?”
-Victoria
ভিক্টোরিয়ার এই চিঠি পাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই লিওনার্ডকে পাঠানো একটি নোটে কবি লিখেছিলেন – “it would never be fair to her to go furhter & that is why for both of us it is better that we should part now.”
তারপর দুজনের সম্পর্ক কীভাবে গুরুদেব বিজয়াতে পৌঁছল, তা শুধু তাঁরাই জানতেন ।
তথ্যসুত্র- In Your Blossoming Flower Gardens – Ketaki Kushari Dyson