হোমPlot1মেদিনীপুরের প্রায় নাম না জানা গ্রাম থেকে বিলেত যাত্রা, দরিদ্র কৃষক পরিবারের...

মেদিনীপুরের প্রায় নাম না জানা গ্রাম থেকে বিলেত যাত্রা, দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তানের বিরল আন্তর্জাতিক সম্মান

মেদিনীপুরের প্রায় নাম না জানা গ্রাম থেকে বিলেত যাত্রা, দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তানের বিরল আন্তর্জাতিক সম্মান

আইইইই পিইএস প্রভা এস কুন্ডুর পাওয়ার সিস্টেম ডায়ানামিক্স অ্যান্ড কন্ট্রোল অ্যাওয়ার্ড ২০২৫। এক নজরে পুরস্কারের এই দীর্ঘ নামটা খটমট মনে হতে পারে। আমজনতা বিশেষত আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এই পুরস্কারের তেমন পরিচিতি না-ও থাকতে পারে।  তবে এই পুরস্কার প্রাপ্তি এক বিরল আন্তর্জাতিক সম্মান। বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ বিশ্বব‍্যাপী অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার দিয়ে থাকে আইইইই (ইনস্টিটিউট অফ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স) পিইএস (পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি সোসাইটি)। এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের বিশ্বের সবদেশ জুড়ে মোট ৪৫০টি শাখা অফিস রয়েছে । মোট নথিভুক্ত সদস‍্য সংখ‍্যা ৪০ হাজরেরও বেশি।

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কাঁসাই নদীর কোল ঘেঁষা কিশমৎ রাজপুরা গ্রামের সন্তান লন্ডন-প্রবাসী ডঃ বিকাশ পালকে এই সম্মানে ভূষিত করেছে আইইইই পিইএস। শুধু তাই নয়, বিকাশ বাবুকে আরও বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছেন। তিনি আইইইই পিইএস-এর প্রেসিডেন্ট (২০২৬-২০২৮) নির্বাচিত হয়েছেন। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত বিশ্বের সেরা সেরা পেশাদারদের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হল আইইইই (ইনস্টিটিউট অফ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স) পিইএস (পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি সোসাইটি)। সংস্থার ১৪০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও ভারতীয় এবং ইউরোপ ও আফ্রিকা থেকে কেউ এই পদে নির্বাচিত হলেন। তিনজন প্রার্থীর মধ্যে তিনি তাঁর নিকটতম প্রার্থীর তুলনায় কয়েক হাজারের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। বাংলা তো বটেই, গোটা ভারতের কাছে অত্যন্ত গর্বের। বর্তমানে বিশ্বের অত্যন্ত প্রভাবশালী ইঞ্জিনিয়ারদের একজন হলেন বাংলার অজপাড়া গাঁয়ের এই সন্তান।

খড়গপুর ব্লকের একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম কিসমত রাজপুরার এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে ডঃ পালের জন্ম। মুকসুদপুর প্রাইমারি স্কুল, মুকসুদপুর জুনিয়র হাই স্কুল, চংরাচক জগদীশ স্মৃতি বিদ্যালয় এবং দশাগ্রাম এস এস শিক্ষা সদনে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা করেছেন বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সে। এরপর বিশ্বের সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজ থেকে কমনওয়েলথ স্কলারশিপে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন।

২০০১-এ তিনি ইম্পিরিয়াল কলেজে ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি ইলেকট্রিক পাওয়ার সিস্টেমের অধ্যাপক। এছাড়া, আইইইই, রয়্যাল অ্যাকাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং (ব্রিটেন), চাইনিজ সোসাইটি অফ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং (আইএনএই)-র মতো বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের থেকে ফেলোর সম্মানে সন্মানিত। 

৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি লন্ডনের বাসিন্দা। তবে বাংলার শিকড়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কখনও ছিন্ন হয়নি। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে আজ আন্তর্জাতিক স্তরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পশ্চিম মেদিনীপুরে গড়ে তুলেছেন কাজলবাবু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জেলার গরিব ও মেধাবী পড়ুয়াদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে।

আইইইই এবং ডঃ পাল

আইইইই পিইএস-এর সঙ্গে অধ্যাপক পালের যোগসূত্র তৈরি হয় ২০০০ সালে। খুব দ্রুতই তাঁর নিষ্ঠা ও প্রতিভার স্বীকৃতি মেলে। ২০১০-এ তিনি এই প্রকাশনার সম্পাদক এবং ২০১২তে মুখ‍্য সম্পাদক হন। টানা ৬ বছর এই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৯-এ আইইইই পিইএস-এর প্রকাশনার ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। তখন তিনি প্রকাশনার ৮ টি জার্নাল পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন পাঁচ বছর । এও এক বড় সম্মান। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাময়িকীর দেখাশোনা করার পাশাপাশি ৭২ জন মহিলা সম্পাদক সহ ৬০০ জনের বেশি নতুন সম্পাদককে নিয়োগ নেতৃত্বদানের দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। এখানেও নিজের অসামান্য যোগ্যতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন বিকাশবাবু। তাঁর কার্যকালে তিনি দুটি নতুন পত্রিকাও চালু করেন যেগুলি এখন সাফল‍্যের সঙ্গে চলছে।

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অচিরাচরিত বা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির কদর বাড়ছে। এক্ষেত্রেও গবেষণায় এই বঙ্গসন্তানের আন্তর্জাতিক স্তরে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

১৮৮৪ সালে থমাস আলভা এডিসনের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আইইইই পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি সোসাইটির। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৪০,০০০। তবে প্রতি বছর এই প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের মধ্যে মাত্র ০.১ শতাংশকে শীর্ষ পদে বেছে নেওয়া থাকে। 

আইইইই পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি সোসাইটির শীর্ষে ডঃ পালের নির্বাচন শুধুমাত্র তাঁর ব্যক্তিগত মাইলফলক নয়, আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও কারিগরি ক্ষেত্রে ভারতের ক্রমবর্ধমান অবদানের স্বীকৃতিও বটে। আজকের দুনিয়া ক্রমশ পরিবেশ-বান্ধব শক্তির দিকে ঝুঁকছে। সেক্ষেত্রেও অধ্যাপক পালের উদ্ভাবনী দক্ষতা বিশ্বকে নতুন পথ দেখাবে।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img