হোমPlot1Big Breaking : সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নেই

Big Breaking : সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নেই

Big Breaking : সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নেই

নিজস্ব প্রতিনিধি : থেমে গেল ‘ক্ষিদ্দার’ লড়াই। টানা ৪০ দিনের লড়াইয়ের পর মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আজ দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তি অভিনেতা। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।

পয়লা অক্টোবরের থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রবাদপ্রতিম এই অভিনেতা। তাঁর শরীরে জ্বর, সর্দির মতো করোনার উপসর্গ দেখা দেয়। ৫ অক্টোবর করোনা পরীক্ষায় তাঁর পজিটিভ রিপোর্ট আসে। ৬ তারিখ সকাল ১১ টা নাগাদ তাঁকে দক্ষিণ কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি নাগাদ তাঁর করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন চিকিৎসকরা। ক্রমশ সুস্থও হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। বাড়তে থাকে মস্তিষ্কের স্নায়ুজনিত সমস্যা।

তাঁর চিকিৎসার জন্য তৈরি করা হয়েছিল ১৬ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড। বয়সের পাশাপাশি প্রস্টেট ক্যান্সার সহ সৌমিত্রবাবুর একাধিক কো-মর্বিডিটি থাকায় প্রথম উদ্বিগ্ন ছিলেন চিকিৎসকরা। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁর শ্বাসকষ্টেরও সমস্যা ছিল।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে এই রাজ্য তথা দেশের বৌদ্ধিক দারিদ্র আরও বাড়ল। কলকাতার অহংকারের শেষ চূড়াটি ভেঙে গেল। এই মাপের অভিনেতা ও বুদ্ধিজীবী আইকন আর কেউ রইলেন না।

নদিয়ার কৃষ্ণনগর থেকে এই শহরে এসে সত্যজিৎ রায়ের মানসপুত্র সৌমিত্র অপু হয়ে বিশ্ব জয় করেছিলেন। ফেলু মিত্তির নামে গোয়েন্দার চরিত্রে তাঁর বিকল্প খুঁজে পাওয়া যায়নি। মঞ্চে একের পর এক সফল নাটকে অভিনয়, অনুবাদের ক্ষেত্রেও তিনিই তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে তিনি ছিলেন অভিনেতা।

আবার অন্যদিকে সৌমিত্র অজস্র কবিতা, গদ্য লিখেছেন। পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ছবি আঁকতেন। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুনীল, শক্তির কবিতা আবৃত্তি বই না দেখে একটার পর একটা করতে তাঁর ক্লান্তি ছিল না। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিল তাঁর মানসিক সখ্যতা। গান তিনি গাইতেন, নিজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে।

বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর আড্ডার সাক্ষীরা জানেন কী ধরনের আড্ডাবাজ ছিলেন উনি। প্রচুর পড়তেন। নানা ভাষার ডিকশনারিও ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। মননে, চিন্তায় সৌমিত্র ছিলেন বামপন্থী। মানুষের কথা ভাবতেন। কিন্তু বামজমানায় তাঁকে দেখা যায়নি ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরাঘুরি করতে। একদল বুদ্ধিজীবী নিয়ম করে নানা সুযোগ সুবিধা নিয়েছিলেন। পরে তাঁরা সম্পূর্ণ ভোলবদলে এখনকার ক্ষমতার খুব ঘনিষ্ঠ। সুযোগ সেদিন নিয়েছেন, আজও নিচ্ছেন। এইখানেই সৌমিত্র আলাদা। সেদিন তিনি নেননি। পরেও না। মাথাটি উঁচু করেই ছিলেন। সেইভাবেই চলেও গেলেন। “পুলু”দা বলে গেলেন অনেক কথা, কোনও কথা না বলেই।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম 1935 সালের 9ই জানুয়ারি। ব্রিটিশ শাসিত কৃষ্ণনগরে। কৃষ্ণনগরের সেন্ট জন্স স্কুলে পড়াশোনা শুরু করে পঞ্চম শ্রেণীর পর হাওড়া জেলা স্কুল ও পরবর্তী কালে আমহার্স্ট স্ট্রিট সিটি কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়াশোনা।

চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আদি বাড়ি ছিল (অধুনা বাংলাদেশে) শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রামে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতামহের আমল থেকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে থাকতে শুরু করেন। সৌমিত্রর পিতৃদেব কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতেন এবং সপ্তাহান্তে বাড়ি আসতেন।

অভিনয়ে ঝোঁক ছিল ছেলেবেলা থেকেই। তবে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু হয়েছিল আকাশবাণী থেকে। অভিনেতা নয়, ঘোষক হিসেবে। বাচিক শিল্পী হিসেবে সেই সময় যথেষ্ট সুনামও কুড়িয়েছিলেন। অভিনয়ে তাঁর প্রথম গুরু ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী। তবে শিশির ভাদুড়ির একটি নাটক দেখার পরে পাকাপাকি অভিনয় জগতে আসার সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৫৬ সাল। তাঁর ‘অপরাজিত’-র জন্য নতুন মুখের খোঁজ করছেন সত্যজিৎ রায়। বিশ্ববন্দিত পরিচালকের সঙ্গে তখনই প্রথম আলাপ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। সদ্য কলেজ থেকে বেরিয়েছেন। সৌমিত্রর তখন ২০ বছর বয়স। অপুর ভূমিকায় সৌমিত্রকে পছন্দ হলেও, বয়সের কারণে তাঁকে বাতিল করে দেন পথের পাঁচালির পরিচালক। অবশেষে ২ বছর এল সেই মুহূর্ত। সত্যজিৎ তখন ‘জলসাঘর’-এর শুটিংয়ে মেতে রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান সৌমিত্র।

শুটিংয়ের ফাঁকে ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে সৌমিত্রর পরিচয় করিয়ে দেন সত্যজিৎ। বললেন, “এ হল সৌমিত্র। আমার পরের ছবি ‘অপুর সংসার’-এ অপুর চরিত্রে অভিনয় করছে।” কার্যত বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন সৌমিত্র। কারণ, সেই প্রথম তিনি জানতে, সত্যজিতের ছবিতে অভিনয়ের কথা। অস্কারজয়ী সত্যজিৎ রায়ের 34টি ছবির মধ্যে 14 টিতেই অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

১৯৬১ সাল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় জীবনে এক বড় মাইলস্টোন। ওই বছরেই মুক্তি পেল তপন সিনহার ‘ঝিন্দের বন্দী’। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিতে সৌমিত্রকে দেখা গিয়েছিল খলনায়কের ভূমিকায়। তার আগেই অপু হিসেবে দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। এরপর ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দেবী’, ‘সমাপ্তি’, একের পর এক বক্স অফিস সফল ছবি।

১৯৭০-এ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নিলেও, তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর কারণ ব্যাখ্যা করে পরে তিনি বলেছিলেন, সেই সময়ে সিনেমার উন্নয়নে কিছুই কলছিল না সরকার। তাই তিনি ব্যক্তিগতভাবে পুরস্কার নিতে চাননি। ২০০৪ সালে তাঁকে পদ্মভূষণ-এ দিয়ে সম্মানিত করে কেন্দ্র। 2012 সালে পান ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার।

দুবার ফ্রান্সের দুটি সর্বোচ্চ সম্মানও পেয়েছেন, যা আর কোনও ভারতীয় অভিনেতার ঝুলিতে নেই। এর মধ্যে রয়েছে,

ক) ‘অর্ডার দি আর্ট এ দে লেটার’ হল শিল্পীদের জন্য ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান। ভারতীয় সিনেমায় তিনিই প্রথম এই সম্মানে ভূষিত হন।

খ) ‘লিজিয়ঁ অফ অনার’ হল ফ্রান্সের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান, এদেশের ভারতরত্ন-র তুল্য। প্রথম কোনও ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে ২০১৮ সালে এই সম্মানে ভূষিত হন।

‘অপু’ থেকে ‘ফেলুদা’, বহু স্মরণীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তবে সত্যজিতের ছবির বাইরেও একাধিক ছবিতে তাঁর অভিনয় দাগ কেটেছে। মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় করের মতন পরিচালকদের ছবিতে কাজ করেছেন।

‘কোনি’ ছবির বিখ্যাত সংলাপ– ‘ফাইট কোনি ফাইট’ আজও মুখে মুখে ঘোরে। আর খিদ্দার চরিত্রে সৌমিত্রর অবিস্মরণীয় অভিনয়। ‘আতঙ্ক’ ছবিতে শিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয়। ছবিটির সেই সংলাপ– ‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছু দেখেননি’। ছবি দুটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৬তে।

2013 সালে বঙ্গবিভূষণ প্রত্যাখ্যান করেন। এই পুরস্কারে তাঁকে আবার 2017 সালে ভূষিত করা হয়। শুধু সিনেমায় অভিনয় নয়, কবি, আবৃত্তিকার, নাট্যকার, অনুবাদক, চিত্রশিল্পী, এককথায় এক বহুমুখী বিরল প্রতিভা।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img