ড. বিকাশ পাল, ইম্পিরিয়াল কলেজ, লন্ডন
কয়েক দিন বেশ রোদ উঠছে আমার বাড়ির আশেপাশে। গত সপ্তাহ থেকে শরীরে অতিমারির সংক্রমণ ধরা পড়েছে। সুতরাং নিভৃতবাস। অসহ্য। গতকাল আর আজ বেরোলাম বাড়ির সামনের ফাঁকা মাঠে। সূর্যের ঝলমলে আলো, কার না ভালো লাগে, বিশেষ করে কয়েকদিন ঘরবন্দি দশা, আমি মুখিয়ে ছিলাম। বলাকায় রবিঠাকুর লিখেছেন, “ভালো বাসিয়াছি এই জগতের আলো, জীবনেরে তাই বাসি ভালো।”
যিনি আলোর কবি, তিনি এ তো লিখবেনই। সত্যি আলো, গাছের পাতা, নীল আকাশ, আমাকে সব সময় এক স্বপ্নের জগতে নিয়ে যায়। হয়ত ওটাই আমার ভেতরের মানুষটির সত্যিকারের জায়গা। আর যে জীবন যাপন করি, সে যেন এক গম্ভীর বিদ্রূপ। আজ রাস্তায় দেখলাম চেরি ব্লসম ফুটেছে। এই সময় আবার বসন্তের হোলি দেশে। সেখানে এখন কত লোকের মেলা, আর কত রঙের খেলা। এসব ভাবছি আর হাঁটছি। ফুল দেখে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত মনে এলো, “আহা আজই এ বসন্তে এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়।”
অনেকেই এই গানটি গেয়েছেন – আমার আবার রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গলায় এটা শুনতে বেশি ভালো লাগে। তিনি আমার পছন্দের শিল্পী। কনিকার কাছে তালিম নিয়েছেন, অসাধারণ গায়কী। রেজওয়ানার কথা বলতে মনে এল ২০১৯ সালে মার্চ মাসে আমার ঢাকাতে থাকার কথা। ঠিক ১৫-১৯ মার্চ, এই সময়টাতেই ছিলাম ওখানে ৪-৫ দিন। একটা বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন। বাংলাদেশ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহিদুল ইসলাম খান ডেকেছিলেন। বেশ ভালো মানুষ শাহিদুল দা। ফোনে কথা হলেই জানতে চান, বিকাশ ঢাকায় কবে আসবা? তাই চলে গেলাম।
সন্ধেবেলায় বেশ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। সম্মেলনের জনসংযোগ অধিকত্রী ইশমত শিরীন জানতে চাইলেন, কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না। কেমন লাগছে ঢাকা ? আমি বললাম বেশ ভালো। এটা ওটার পর প্রসঙ্গ উঠল লন্ডনে দু’বাংলার সিনেমা আর গানের। বললাম, বাংলাদেশের রেজওয়ানা বন্যার গান বেশ ভাল লাগে। দেখা করার সুযোগ হলে ভালো হত। উনি বললেন, তাই। তবে অদিতি (মহসিন), রেজওয়ানারা সব সময় বিদেশেই বেশি অনুষ্ঠান করেন। পাওয়া মুশকিল। পরের দিন সকালে উনি আমায় এসে বললেন, “বিকাশবাবু কাল রাতে আমি আমার একজন বন্ধু, যিনি ওনার গানের স্কুলে কাজ করেন, তাঁকে বললাম আপনার ইচ্ছের কথা। উনি আজ সকালে আমাকে বললেন, আজ বিকেলে রেজওয়ানাদি কলকাতা থেকে ফিরছেন সরাসরি গানের স্কুলে। একটা মিটিং, তারপর সন্ধেবেলায় ওনার সাথে ১৫ মিনিট ওনার অফিসে দেখা করা যাবে। রেজওয়ানাদিকে বলা হয়েছে, লন্ডনের এক বাঙালি অধ্যাপক আপনার গানের মুগ্ধ এক শ্রোতা, আপনার সাথে দেখা করতে চান। রেজওয়ানাদি কলকাতা থেকেই মেসেজে কনফার্ম করেছেন।”
আমার তখন কী আনন্দ! এ যে মেঘ না চাইতেই জল। ইসমত নিজেই আমায় তাঁর গাড়িতে নিয়ে চললেন। সেখানে এক বিরাট কান্ড। বহু বাচ্চা ছেলেমেয়ে গান শিখছে। সকলেই প্রায় বস্তির ছেলেমেয়ে। UNDP-র প্রকল্প। একটা সরকারি কলেজের একটা উইং সন্ধেবেলায় রেজওয়ানাদিকে স্কুলের জন্য দেওয়া আছে। প্রত্যেক ঘরে একজন শিক্ষক। ঘুরে ঘুরে দেখলাম। রেজওয়ানাদি জানতে চাইলেন আমার দেশ , ইম্পিরিয়ালে কী বিষয়ে গবেষণা করি, তাঁর কোন গানগুলি আমার ভালো লাগে ইত্যাদি। আমি বললাম, “আমার জ্বলেনি আলো অন্ধকারে দাওনা, দাওনা সাড়া কি তাই বারে বারে”, “তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে, যতদূরে আমি চাই”, “না চাহিলে যারে পাওয়া যায়”, “আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে”, “আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে”। জানতে চাইলাম, না চাহিলে যারে পাওয়া যায়-এর সঞ্চারিতে অশ্রুজল কথাটা কি করে এত সুন্দর গাইতে পারেন?
জীবন আপনার নিশ্চয়ই রবীন্দ্রময়, না হলে এভাবে কি গাওয়া যায়? শুনে বললেন, দারুণ কথা বললেন তো। উনি বললেন , আমার রবীন্দ্রনাথের জীবন দর্শনকে আশ্রয় করেই তো বেঁচে থাকা। আমি তাঁকে অনুভব করতে পারি। তবে মোহরদি আমায় ঐ গানটা ঐভাবেই শিখিয়েছেন। ঐ জায়গায় ডেলিভারিটা করার সময় একটু অন্যভাবে করি, স্পর্শ, স্বর, মির বলে কিছু কিছু ব্যাপার আছে গানের, সেগুলো লাগাতে হয় খুব সূক্ষ্ম ভাবে, সুরকে পেছনে রেখে ইমোশানকে সামনে আনতে হয়, এই , আর কিছু না। আজ কলকাতা থেকে এসেছি, একটু ক্লান্ত, না হলে অফিসে আপনাকে একটা আপনার পছন্দের গান শোনাতাম।
বললাম ২০০৬ সালে যেদিন আমার বাবা চলে গেলেন , সেই দিন থেকে টানা ৮-১০ দিন লন্ডনে আপনার গাওয়া ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে’ গানটা শুনেছি , রোজ কত বার, মনে হোতো পাশে বসে কেউ যেন আমায় সান্ত্বনা দিচ্ছেন। গান শুনে নিজেকে সামলেছি। উনি একথা শুনে অভিভূত। সঙ্গে সঙ্গে না চাহিলে যারে পাওয়া যায় গানটির সঞ্চারি থেকে ধরলেন চেয়ারে বসে খালি গলায়, “তারি লাগি যত ফেলেছি অশ্রুজল, বীণা বাদিনীর শতদলদলে করিছে সে টলমল”। বলেই থেমে গেলেন।
২০ খানা গানের সিডি উপহার দিলেন আমায়। বললেন, লন্ডনে ১২ জুলাইয়ে প্রোগ্রাম আছে, লোগান হলে আসবেন । আপনার পছন্দের দু এক খানা গান গাইবো। তার আগে এসে দেখা করে মনে করিয়ে দেবেন। যেগুলো বলবেন, সেগুলো ডায়েরিতে স্টিকার মার্ক দিয়ে রেখে দেবো, যাতে ভুলে না যাই। আমি বললাম, আপনার সাথে অনুষ্ঠানের আগে দেখা করতে যদি না দেয় উদোক্তারা, তাহলে কী হবে? তখন উনি একটা ওনার কার্ডের পেছনে লিখে দিলেন, বিকাশবাবুর সাথে আমার দেখা হয়েছিল ।
আমি বললাম, দিদি আপনি এত আমার প্রতি আগ্রহ দেখালেন, সিডি দিলেন, আমি তো খালি হাতেই এলাম। আপনাকে একটা প্রণাম করতে চাই। এঁর চেয়ে বড় আপনাকে দেওয়ার মত আমার কিছুই নেই। উনি বেশ ইতস্তত করছেন। আমি বললাম, দিদি রবিঠাকুরই বলেছেন, যিনি দিতে পারেন তিনিই নিতে পারেন। লক্ষ লক্ষ বাঙালি আপনার গান শোনে। এটুকু অস্বীকার করবেন না, এটা আপনার দস্তুর। উনি রাজি হলেন। তারপর দু-এক মিনিট থেকে আমরা চলে এলাম সেদিন।
সারারাত হোটেলে কেমন একটা মুগ্ধতা মনকে ভরিয়ে রাখল। পরের দিন দুপুরে ব্যাঙ্ককের ফ্লাইট। সেখানে চার দিনের আর একটা বড় সন্মেলন। আট হাজার লোক রেজিস্টেশন করেছে। আমাদের IEEE PES organise করেছে। আমাদের বোর্ডের মিটিং। একদিন আগেই পৌঁছতে হবে। কেননা, প্যাটংপঙ একদিনের জন্য তাঁর কোম্পানি PEA এর লোকেদের দেশের নানান প্রান্ত থেকে এনেছে। প্যাটংপঙ বুনসিরি। সে ইম্পিরিয়ালে আমার কাছে মাস্টার্সের থিসিস করেছে। আমায় তাঁদের একদিনের ট্রেনিং দিতে হবে smart power distribution grid-এর উপর। ব্যাঙ্ককের এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছলাম, তখন সূর্য ডুবু ডুবু করছে। বেরিয়ে দেখলাম প্যাটংপঙ গাড়ি পাঠিয়েছে। পরের দিন ২৫-৩০ জন ইঞ্জিনিয়ারের জন্য দিনভর ট্রেনিং, শুধু শোনার চেয়ে বেশি বলে যাওয়া। ঢাকার অভিজ্ঞতার থেকে কত আলাদা। জীবনে বৈচিত্রে আমি সব দিনের আগ্রহী। তা না হলে আলুনি লাগে। তাই এখানেও যত্ন নিয়ে এঁদের প্রশিক্ষণের কাজ করলাম।
চারদিন পর ব্যাঙ্কক থেকে দুবাই হয়ে লন্ডন। রেজওয়ানাদির গান প্রায়ই শুনি। হয়ত দেখা হবে আবার , এ আশা আছে।