ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার
আমেরিকা ও জার্মানি থেকে কৃষি বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা শেষ করে ৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৯ সালে রথীন্দ্রনাথ কলকাতায় ফিরে এলে তাঁর বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ এক বৈপ্লবিক সিন্ধান্ত নিলেন। বিনয়নী দেবীর কন্যা বিধবা প্রতিমার সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের বিয়ে দিলেন (২৭ জানুয়ারি ১৯১০)। এটি ঠাকুর পরিবারের প্রথম বিধবা বিবাহ।
বিয়ের পরে রথীন্দ্রনাথ প্রথমে জমিদারির কাজে শিলাইদহ পরে শান্তিনিকেতনে গ্রামোন্নয়নের কাজে নিজেকে উজাড় করে দিলেন। প্রতিমা দেবীও কাঁধে তুলে নিলেন রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের আশ্রমের সব দায়িত্ব। দিন যায়, বছর যায়, নিঃসন্তান রথীন্দ্র-প্রতিমা নিজেদের কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখলেন। এইভাবে কেটে গেল বাইশটা বছর।
দামোদর চতুর্ভুজ নামে এক রবীন্দ্রানুরাগী ব্যবসায়ী তার রুগ্ন স্ত্রীকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে বাস করতেন। তাদের ডল পুতুলের মত ছোট্টো ফুটফুটে শিশুকন্যাটিকে রবীন্দ্রনাথের অনুমতি নিয়ে রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবী দত্তককন্যা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শিশুটির নাম রাখেন নন্দিনী (জন্ম ১৯২২), ডাকনাম হল পুপে বা পুষু। পুপে (Poupee) নামটি রবীন্দ্রনাথের ফরাসি বন্ধু আঁন্দ্রে কার্পেলেসের দেওয়া। তিনি তখন শান্তিনিকেতনে।
ফরাসিতে পুপে কথার অর্থ পুতুল। এ ছাড়াও তার আরও যে কত ডাকনাম, পুপু, পুপসি, রূপসী, লালা। নামের যেন অন্ত নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোট্টো নতুন নাতনিটিকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। তাকে নিয়ে রচনা করেছেন কত গান, কবিতা, গল্প আর ছড়া। পুপে রবীন্দ্রনাথের কর্মমুখর ব্যস্ত জীবনের এক মধুর অধ্যায়।
ছোট্টো পুপে রবীন্দ্রনাথের নানা ভ্রমণের সঙ্গী। রবীন্দ্রনাথের কাজে মধ্যে সে আপন মনে অনর্গল কথা বলে যেত, যার মাথামুণ্ডু তিনি কিছুই বুঝতে পারতেন না। ১৯২৪ সালের অক্টোবর মাস, রবীন্দ্রনাথ তখন প্যারিসে। লিখে চলেছেন গান আর কবিতা। সঙ্গে রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা আর নন্দিনী। নাতনীর সাহচর্যে রবীন্দ্রনাথে মনের কথা ধরা পড়েছে তাঁরই লেখায়, একটি ছোট্টো মেয়ে কোথা থেকে আমার যাত্রাপথে জুটে গেছে। তার বয়স আড়াই বছর। তার মধ্যে প্রাণের আনন্দ টলমল করে ওঠে, কত মধুর প্রলাপ, কত মন-ভোলানো ভঙ্গীতে; আমার মন বলে, মস্ত একটা পাওনা আমি পেলুম’।
সেই ভ্রমণেই পুপের জন্য লিখেছেন ‘কাছের থেকে দেয় না ধরা, দূরের থেকে ডাকে’ কবিতাটি। মীরা দেবীকে লিখেছেন আমার সঙ্গে পুপের ভাব কতটা জমেছে নীচের কবিতা থেকে কটকটা আভাস পাবি। এই সময় থেকে তিনি নাতনীকে তাঁর তিন বছরের প্রিয়া বলে সম্বোধন করতেন। বাঘের গল্পে পুপের ছিল সবচেয়ে বেশী আকর্ষণ। এজন্য রবীন্দ্রনাথকে একটা ছড়াও লিখতে হয়েছিল বাঘ নিয়ে।
১৯২৬ সালে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিশ্রামে রয়েছেন। আদরের পুপের আধো আধো বুলি রবীন্দ্রনাথের মনে যে আনন্দের দোলা দিয়েছিল সেটাই প্রকাশ পেল ৪ এপ্রিলে লেখা অনেক কথা যাও যে বলে, কোনো কথা না বলি গানের ভিতর দিয়ে। নাতনীর বয়স তখন ৪ আর দাদু ৬৪ বছরের শিশু।
অন্যান্য তথ্য
রচনা ৪ এপ্রিল ১৯২৬ | কবির ৬৪ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে রচনা| প্রেম পর্যায়ের গান | স্বরলিপিকার দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর