হোমসাহিত্য-সংস্কৃতিঅণু গল্প : অভিরাম

অণু গল্প : অভিরাম

অণু গল্প : অভিরাম

দেবদাস কুণ্ডু
—কি ব্যাপার তুমি আবার ধূমপান করছো?
—কি করবো? ঘুম যে আসছে না।
—কেন ঘুমের ওষুধ খাচ্ছো না?
—ডাবল ডোজ খাচ্ছি। তবু ঘুম আসছে না।
রিনা খুব চিন্তায় পড়ে গেল। অভিরাম একটু টেনশন করে চিরকাল। কিন্তু এখন তো ওর
তেমন একটা কিছু হয়নি। সরকারি চাকরি
করে। তার চাকরি যাবার ভয় নেই।

কয়েকদিন আগে শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে ছিল। তখন চিন্তায় ঘুম হচ্ছিল না। শাশুড়ি এখন ভালো আছে। সরকারি আবাসনে ছোট দেওরের সঙ্গে থাকে। তাহলে ওর কেন ঘুম হচ্ছে না?
রিনা বলল—কবে থেকে ঘুম হচ্ছে না?
–লকডাউনের পর থেকে ।
—তিন মাস হতে চলল। আমাকে এতদিন বলো নি কেন?
—কি বলবো তোমায়? তুমিও চিন্তা করতে শুরু
করবে।
—-চিন্তা করবো না? তোমার যদি কিছু হয়ে যায়?
—–তুমি চিন্তা করে কি কিছু করতে পারবে?
—-কিন্তু আমার প্রশ্ন, তুমি হঠাৎ কি ব্যাপারে
চিন্তা করছো আমাকে বলবে?
—–না বলার কি আছে। করোনায় যে এতো
মানুষ মারা যাচ্ছে তাই নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। কখন
কার যে করোনা হচ্ছে, কেউ বলতে পারছে না। সুস্থ মানুষ হঠাৎ সর্দি কাশি হলো। সোয়াব
টেস্ট হলো, ধরা পড়লো করোনা। তিনদিনে শেষ। লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে
এই হারে মানুষ মরতে থাকলে একটা ভয় হয় না?
–কিসের ভয়।?
—-পরিবার গুলোর কথা ভাবো। ভেসে যাবে।
–তা যাবে। তুমি কি করতে পারো?
—কিছু করতে পারছি না বলেই তো কষ্ট হচ্ছে। তুমি ভাবো একবার পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা। কাজ নেই। খাবার নেই। টাকা নেই।মাইলের পর মাইল হাঁটছে। রাস্তায় মরে যাচ্ছে অনেকে। একজন গর্ভবতী নারী রাস্তায় সন্তান প্রসব করে দু ঘন্টা রেস্ট নিয়ে আবার হাঁটছে। আমরা কি আদিম যুগে ফিরে গেলাম?
—সরকারের তো উচিত এদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করা।
—করছে কই? তাই তো চিন্তা হচ্ছে।
—অতো চিন্তা করো না?
—-মানুষের দু:খ দেখে মানুষ না চিন্তা করে থাকতে পারে?
—-সরকারকে সবাই বলছে না কেন?
—সব ভোটের রাজনীতি।
—ভোট আসলে তোমার দরজায় আসবে ভোট চাইতে। ভোট হয়ে গেলে তুমি কেউ না।
—-প্রতিদিন কাগজে টিভিতে এতো মৃত্যু সংবাদ দিচ্ছে তবু সরকার কিছু করছে না?
—কিছু করছে না তা নয়। একশো তিরিশ কোটি মানুষের দেশ। ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে
পড়ছে। রোধ করার সময় দিচ্ছে না। মানুষ সচেতন হচ্ছে না। মরছে।
–একটি কথা বলবো?
—বলো।
–তুমি তো কোনদিন নিজেকে ছাড়া আর কিছু ভাবো নি। আজ হঠাৎ তোমার এই চিন্তা কেন?
—তুমি ঠিক বলেছো। আমি একজন স্বার্থপর মানুষ। ছিলাম। কিন্তু করোনা আমাকে পাল্টে যেতে বাধ্য করছে।
—কি রকম?
–তুমি জানো রিনা আমাদের অফিসে রবীনদা করোনাতে মারা গেল।
—-সে কথা তুমি সেদিন বলেছো অভিরাম।
—আমাদের ক্লাবের মহিমদা যে আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো সেই মহিমদা গতকাল করোনায় মারা গেল। রবীনদা-মহিমদা দেখা হলেই বলতো – – কেমন আছো হে অভিরাম? বউ ছেলে মেয়ে
ভালো আছে তো? তোমার মা এখন কেমন আছেন? তোমার নিজের শরীর ঠিক আছে তো? মর্নিং ওয়ার্ক করছো তো? সাবধানে
থেকো।
—-হ্যাঁ বুঝলাম।
—কি বুঝলে?
—ওরা তোমায় ভালোবাসতো খুব।
—-সেই ভালোবাসার মানুষগুলি যদি একে একে চলে যায়।
তবে কে আমাকে ডেকে বলবে—ওহে অভিরাম কেমন আছো?
আর কেউ যদি তোমার ডেকে জিজ্ঞেস না করে তুমি বুঝবে কি করে, তুমি বেঁচে আছো?
এবার রিনার শরীর ভয়ে কেঁপে উঠলো।
—চরম সত্যি কথাটা তো তুমি বললে। আমি তো একবারো এই দিকটা ভেবে দেখি নি। এতদিন তোমাকে স্বার্থপর বলেছি। আমি কি কম স্বার্থপর?
—আমরা সাধারণ মানুষ। কম বেশি সবাই স্বার্থপর।

কিন্তু এখন স্বার্থপর হয়ে বাঁচতে পারবে না। কেন জানো?
রিনা অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে-কেন?
—-পৃথিবীতে যদি মানুষই না থাকলো তুমি একা একা
বাঁচবে কি করে? সেই বাঁচায় কোনও আনন্দ থাকবে?
রিনা কোন জবাব দিতে পারে না।
–সেই বাঁচা হবে স্বার্থপর দৈত্য।

spot_img
spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img