এক চরম দুরবস্থার শিকার বাংলা ও বাঙালির গর্বের প্রতিষ্ঠান বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ। প্রতিষ্ঠানের নিত্যদিনের কাজকর্ম থেকে পরিচালন ব্যবস্থা সব ক্ষেত্রেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে যাঁরা ১৩০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, তাঁরা এই অরাজক পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে অভিযোগ। পরিষৎ-এর প্রাক্তন সহ সভাপতি ও পত্রিকাধ্যক্ষ সুবিমল মিশ্রের অভিযোগ, ক্রমশ ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানকে।
তিনি জানান, ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের পক্ষ থেকে পরিষৎ-এর উন্নয়নের জন্য কর্পাস ফান্ড হিসেবে দশ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি তিন মাস অন্তর বৈঠক করে তার রিপোর্ট সংস্কৃতি মন্ত্রককে পাঠানোর কথা৷ কিন্তু নতুন কোষাধ্যক্ষ দায়িত্ব নেওয়ার পর একটিও বৈঠক করেননি, যার জেরে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে, তাতে কর্পাস ফান্ডের উপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে বলে সুবিমলবাবুর অভিযোগ। তাঁর অভিযোগ, কর্পাস তহবিল আনার ব্যাপারে যাঁরা বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁদের কাউকেই পরিষদে রাখা হয়নি।
সহ সম্পাদক অভিজিৎকুমার ঘোষ বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিবাদ করায় তাঁকেও পদে পদে অপদস্থ করার অভিযোগ উঠেছে। এখন তাঁর উপর ন্যস্ত সমস্ত অতিরিক্ত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন শ্রীঘোষ।
পরিষৎ-এর পক্ষ থেকে প্রতি বছর যে স্মারকবক্তৃতা ও আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়ে থাকে, গত এক বছর ধরে তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ আলোচনাসভা পরিচালনার জন্য নতুন অধ্যক্ষের নামও মনোনীত করা হয়নি৷
বর্তমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নিয়ম ভেঙে কোনওরকম বিজ্ঞাপন ছাড়াই কর্মী নিয়োগের অভিযোগ উঠেছে। লাইব্রেরিতে গ্রন্থ পঞ্জিকরণের কাজের জন্য যাঁকে নিযুক্ত করা হয়েছে, তাঁর কোনো শংসাপত্র নেই৷ তাই কার্যনির্বাহক সমিতির অনুমোদন ছাড়াই তাঁকে গ্রন্থাগারের পরিবর্তে অফিস কর্মী হিসেবে নিয়োগ করা হয় বলে অভিযোগ। তবে চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত ওই কর্মীকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
পরিষৎ-এর গ্রন্থাগার এবং সংগ্রহশালাকেও অনৈতিকভাবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। প্রকাশনা বাবদ গত পাঁচ বছরে খরচ করা হয়েছে প্রায় ৭০ লক্ষ টাকা, সেখানে বই বিক্রি হয়েছে ৩০ লক্ষ টাকার কাছাকাছি৷ এই বিপুল টাকার লোকসান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
পরিষৎ প্রকাশনা থেকে গত পাঁচ বছরে যে সব বই ও পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়ম মেনে প্রকাশনা উপসমিতির সভা করা হয়নি। অধ্যক্ষ তাঁর খেলায় খুশি মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে অভিযোগ। লেখক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তাঁর বিরুদ্ধে চরম স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। যোগ্যতা বিচার না করেই নিজের পছন্দের লোকদের তিনি পরিষৎ পত্রিকায় লেখার সুযোগ করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ।
অভিযোগ উঠেছে, সম্প্রতি পরিষৎ-এর বার্ষিক সাধারণ যাবতীয় নিয়মনীতি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে অগ্রাহ্য করে বর্তমান পরিচালন গোষ্ঠী নিজেদের পছন্দমতো প্যানেল তৈরি করেছে।
পরিষৎ-এর গ্রন্থাগার, পুথিশালা ও চিত্রশালা থেকে দিনের পর দিন নানা মূল্যবান সামগ্রী খোয়া যাচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে কোনোরকম হেলদোলও নেই বলে অভিযোগ।
বাঙালির নিজস্ব গৌরবের ‘আইকন’ হয়ে উঠেছিল পরিষৎ। জন্মলগ্ন থেকে আমৃত্যু রবীন্দ্রনাথ নানা ভাবে পরিষদের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, যদুনাথ সরকার, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় – শতাধিক বছরের যাত্রাপথে বাঙালি মনীষার একটা বড় অংশ কোনও না কোনও ভাবে এই প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করেছেন।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ তার জন্মলগ্ন থেকেই বিবিধ ভাবনার চিন্তাধারায় সমৃদ্ধ হয়েছে, পথ দেখিয়েছে বঙ্গবিদ্যাচর্চাকে। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানের আজকের এই দুরবস্থায় কর্তৃপক্ষের ভূমিকায় হতাশ বাংলার বিশিষ্টজনেরা। একগুচ্ছ অভিযোগ নিয়ে পরিষদের বর্তমান পদাধিকারীদের বক্তব্য জানার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ঔদ্ধত্য দেখিয়ে তাঁরা জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন।