হোমসাহিত্য-সংস্কৃতিরবীন্দ্রনাথের ভাবনায় স্বামীজি

রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় স্বামীজি

রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় স্বামীজি

(লন্ডন প্রবাসী বিশিষ্ট অধ্যাপক ড. বিকাশ পাল এই লেখায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে আলোকপাত করলেন শুধুমাত্র এই পোর্টালের জন্য।)
“এবার আসনি তুমি বসন্তের আবেশ হিল্লোলে
পুষ্প দল চুমি –
এবার আসনি তুমি মর্মরিত কুজনে গুঞ্জনে
ধন্য ধন্য তুমি।
রথচক্র ঘর্ঘরিয়া এসেছ বিজয়ী রাজসম
গর্বিত নির্ভয়-
বজ্র মন্ত্রে কি ঘোষিলে বুঝিলাম নাই বুঝিলাম
জয় তব জয়।।“
রবীন্দ্রনাথের বর্ষশেষ কবিতায় স্বামী বিবেকানন্দের ভাবনার প্রতিফলন হয়েছে। ১৬০ বছর আগে স্বামীজি এই পৃথিবীতে এসেছিলেন। স্বামীজি বিশ্ব জয় করে দেশে ফিরেছেন। কলকাতা সহ সারা দেশের মানুষ তাঁর জন্য গর্বিত। রবীন্দ্রনাথও। যদিও সেভাবে তিনি স্পষ্ট করে খুব বেশি কিছু না লিখলেও তাঁর অনেক আলোচনা আলাপচারিতায় স্বামীজির প্রশংসা করেছেন কবিগুরু।

অনেকে মনে করেন, স্বামীজির সাথে রবিঠাকুরের খুব একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না। তাঁরা সুযোগ পেলেই এই দুই মহা পুরুষের মধ্যে তুলনা করে বসেন। আমার ধারণায় এটা যারা করেন, সেটা তাঁদের স্থূল দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়।

এক সময় স্বামীজি অনেক রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন। “তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা”, “তুমি বন্ধু তুমি নাথ , তাহারে আরতি করে চন্দ্র তপন”, এই ব্রহ্ম সঙ্গীতগুলি স্বামীজি গেয়েছেন সবই রবীন্দ্রনাথের কথা ও সুরে – অনেক পরে এগুলি রবীন্দ্রসঙ্গীত বলে পরিচিত হয়েছে। প্রথম গানটি স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব শুনেছেন স্বামীজির কণ্ঠে। “মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে” কীর্তনাঙ্গের এই গানকে কণিকা, সুচিত্রা, অশোকতরু জনপ্রিয় করলেও, স্বামীজি এটি বেনারসে গেয়েছিলেন। আর তা বালক ক্ষিতিমোহন সেন (অমর্ত্য সেনের মাতামহ) নিজের কানে শুনেছিলেন।

স্বামীজি প্রথম প্রথম ব্রাহ্ম সমাজের অনুষ্ঠানে যেতেন। উত্তর কলকাতার শিব গুহদের বাড়ির ছেলে অন্নদা গুহের সাথে। তখন তিনি নরেন্দ্রনাথ। আদি ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ নরেন্দ্রকে ভীষণ স্নেহ করতেন আর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে ডেকে প্রায় খাওয়াতেন। নরেন্দ্র খেতে খুব ভালোবাসতেন। ব্রাহ্ম সমাজের ঋষি রাজ নারায়ণ বসুর মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের লেখা দুই হৃদয়ের নদী একত্রে মিলিল যদি – রবীন্দ্রনাথ আর নরেন্দ্রনাথ একসাথে গেয়েছিলেন।

নরেন্দ্রনাথের ওজস্বী গলা। তিনি ধ্রুপদ, ধামা, খেয়াল সব গাইতে পারতেন তানপুরা বাজিয়ে। স্বামীজির বাড়িতে গানের নিয়মিত চর্চা হত। স্বামীজির বাড়িতেই উস্তাদ আলাউদ্দিন খান হাবু দত্তের থেকে প্রথম গান বাজনার তালিম নেন। পরে পরমহংস রামকৃষ্ণদেবের আরেক রসদদার ভক্ত সুরেন্দ্রর বাড়িতে ঠাকুরের সাথে প্রথম দেখা হয় নরেনের – তাতেই জীবনের মোড় ঘুরে যায় । তা না হলে আজ ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাস অন্যরকম হতেও পারতো।

ভগিনী নিবেদিতার বাগবাজারের বাড়িতে স্বামীজি, রবীন্দ্রনাথ, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু একদিন চায়ের নেমন্তন্ন রক্ষা করেন। রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ভবানীপুরের স্বামীজির স্মরণ সভায় পৌরোহিত্য করেছেন। গয়ায় ভগিনী নিবেদিতার উদ্যোগে ১৯০৪ সালে The Vivekananda Institute-এর অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ অংশগ্রহণ করেন। ১৯০৫ সালে বেলুড় মঠে স্বামীজির জন্মদিন উদযাপন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন। স্বামীজি কম লিখেছেন, তাঁর সব লেখাই রবিঠাকুরের পড়া। রবিঠাকুর কত লিখেছেন। তবে তার খুব কমই স্বামীজি পড়েছেন। স্বামীজির ‘প্রাচ্য পাশ্চাত্য’ বইটির উৎকর্ষতার প্রশংসা করেছেন কবিগুরু। ‘গোরা’ উপন্যাসের মূল চরিত্র গোরা একেবারে স্বামীজির চরিত্রের আদলে গড়া। তাঁর দেশপ্রেম, তাঁর মানুষের জন্য ভাবনা, এসব কিছুর সাথে স্বামীজির ভাবনার কত মিল।

রবিঠাকুর গীতাঞ্জলি লেখার অনেক আগেই স্বামীজি দেহত্যাগ করেছিলেন। তার ১০-১২ বছর পর নোবেল পুরস্কার পেয়ে তিনি রবিবাবু থেকে বিশ্বকবি হয়েছেন। তাই স্বামীজির জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথের উৎকৃষ্ট সাহিত্য কর্ম ততটা সৃষ্টও হয়নি।

দুজনের সাথে দুজনের গাঢ় বন্ধুত্ব না থাকলেও পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল। তা রবিঠাকুর দেখিয়েছেন। কেননা তিনি স্বামীজির মৃত্যুর পর ৪০ বছর ধরে স্বামীজীর জগত জোড়া খ্যাতির সাক্ষী থেকেছেন।

সূত্রঃ
১) শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামী বিবেকানন্দ ( প্রাসঙ্গিক তথ্য সহ)
২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : শঙ্করী প্রসাদ বসু ও বিমল ঘোষ সম্পাদিত

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img