বর্ণালী জানা
ওই যে মুখে দগদগে পোড়া ঘা নিয়ে যে মেয়েটা আদালতে চক্কর কাটছে তার নাম লক্ষ্মী আগরওয়াল। মেঘনা গুলজারের ফিল্মের দৌলতে নামটা সবার জানা। দেশের কোনায় আরো কত লক্ষ্মী রয়েছে…যারা শরীরে অ্যাসিডের ক্ষত নিয়ে জীবন্মৃত হয়ে নিয়ে কাটাচ্ছে , তাদের হিসাব আর কে রাখছে! অ্যাসিডে তাদের শুধু শরীর পোড়েনি…পুড়ে গেছে তাদের মন…তাদের আত্মা। তারা বলেছিল ‘না’। তারা পুরুষের প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল। পুরুষতন্ত্র কখনও মেয়েদের ‘না’ সহ্য করে না। তাই এই প্রতিশোধ…এই জিঘাংসা!
জেসিকা লালের কথা মনে পড়ছে? সেও বলেছিল ‘না’। বার কাউন্টার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সে মদ পরিবেশন করতে চায়নি। তার এই ঔদ্ধত্যও পুরুষতন্ত্র সহ্য করেনি। গুলিতে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিল জেসিকার শরীর।
কিংবা বেশ কয়েক বছর আগে সাড়া ফেলে দেওয়া শান্তিনিকেতনের ঐ মার্ডার কেস! সেখানেও মেয়েটির ‘না’ শুনে তাকে সার্ভিস রিভলভার দিয়ে গুলি করে মেরেছিল প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক (?)।
ধর্ষকদের মানসিকতা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এক সাংঘাতিক তথ্য দিয়েছিলেন এক গবেষিকা। বিভিন্ন জেলে গিয়ে সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষকদের সঙ্গে কথা বলে তিনি লিখেছিলেন, বেশিরভাগ ধর্ষকের মনে কোনও অনুশোচনা নেই। তারা মনে করে নারীকে ভোগ করাটা তাদের জন্মগত অধিকার। তারজন্য মেয়েটিরও যে সম্মতি প্রয়োজন তা তাদের মাথাতেও আসেনা।
মোদ্দাকথা, পুরুষতন্ত্রের মাপ মতো নিজেকে গড়ে নিতে হবে মেয়েদের। সে হবে পুরুষের বাধ্য অনুগত। সকালের চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে রাতের বিছানা…মেয়েদের শুধু বলতে হবে ‘হ্যাঁ’। পুরুষের সব ইচ্ছায় তাকে সায় দিতে হবে। প্রেমহীন দাম্পত্য, মনহীন শরীর দেওয়া-নেওয়া মেনে নিয়েও ‘সুখী’ ঘরণীর ভান করে যেতে হবে। কোথাও কোনও ‘না’ নেই। মেয়েদের ‘না’ বলাটা এমন একটা অপরাধ যা কখনো ক্ষমা করা যায় না। বিয়ের পর বাপের বাড়ি থেকে পণ আনব ‘না’ বললে পুড়িয়ে মারতে হবে। প্রেমের প্রস্তাবে ‘না’ বলে দিলে তাকে খুন করতে হবে, ধর্ষণ করে সারা জীবন দগ্ধে, দগ্ধে মারতে হবে।
আর কোথায় তাহলে ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে? যেখানে ‘হ্যাঁ’ বললে পুরুষের সুবিধা সেখানে। লক্ষ্মী মেয়ের মতো বাবার দেখে দেওয়া ছেলের সঙ্গে বিয়েতে ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির কথায় কন্যাসন্তানকে পেটেই মেরে ফেলতে হবে। পান থেকে চুন খসলে আর রক্ষে নেই। এদেশের বেশির ভাগ মেয়েই অবশ্য মুখ বুজে সব মেনে নেয়। মেয়েদের ভুলচুক হলে তা সে যতই তুচ্ছ হোক না কেন, দু-একটা চড় থাপ্পড় যে তাকে খেতে হবে সেটাই স্বাভাবিক! তাই হালফিলের ‘থাপ্পড়’ ছবিতে স্বামীর হাতে থাপ্পড় খেয়ে অমৃতা যখন ডিভোর্স চায় তখন সবার কপালে চোখ! এই সামান্য ব্যাপারে (?) মেয়েরা যদি আদালতে ছোটে তাহলে দেশের অর্ধেক বিয়েই যে ভেঙে যাবে! অন্তঃস্বত্ত্বা জেনেও অমৃতা যখন স্বামীর কাছে ফিরে আসে না…তখন সিনেমা হলের পাশে বসা লোকটিও বলে ওঠেন ‘এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে!’
বাড়াবাড়ি তো হবেই! যে বলিউড একদিন পতিনিষ্ঠ আদর্শ নারীর ছবি দেখিয়ে এসেছে সেখানে চেনা ছকের বাইরে বেরোলেই বাড়াবাড়ি! এতদিন বলিউড দেখিয়ে এসেছে ছেলেরা মেয়েদের বিরক্ত করবে, উত্যক্ত করবে …কিন্তু সেই ছেলেটির প্রেমেই মেয়েটিকে পড়তে হবে… ‘না’, সে বলতেই পারবে না।
বাড়াবাড়ির সীমারেখা তাহলে কে বেঁধে দেবে?
পুরুষতন্ত্র! যতক্ষণ না পর্যন্ত আমার স্বার্থে আঘাত লাগে ততক্ষণ তুমি বাড়তে পার।
কিন্তু আমার আঁতে বিন্দুমাত্র ঘা লাইলেই মুখোশ খুলে আমার দাঁত-নখ সব বেরিয়ে আসবে! ভালোবাসাহীন সম্পর্ককে কোন মেয়ে টিকিয়ে রাখতে না চাইলে যত অপরাধ সে মেয়ের। ভালোবাসার সব দায় কেন শুধু মেয়েদেরই! ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি না’…এই কথাটা শোনার মতো সাহস কেন ছেলেদের থাকবে না! অক্ষম, কাপুরুষের মতো জোর করে ভোগ করার মধ্যেই কেন তার গৌরব! আজকের দিনে মেয়েরা তাই ‘না’ বলতে শিখুক। আজকের দিনে তারা না হয় একটু ‘অলক্ষ্মী’ই হোক।