বর্ণালী জানা
তালপাতার পটচিত্র, কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি মুখোশ, কাঠ ও পাথরের ওপর খোদাই, ডাবের ওপর বিচিত্র কারুকাজ—রঘুনাথপুর শিল্প নিকেতনে প্রতিনিয়ত চলছে অভিনব এই শিল্পযজ্ঞ। পুরী থেকে মাত্র তেরো কিলোমিটার দূরে এই হেরিটেজ শিল্পগ্রাম। এই গ্রামেই প্রবাদপ্রতিম নৃত্যগুরু কেলুচরণ মহাপাত্রে জন্ম। ছোট্ট গ্রাম। একশ কুড়ি ঘর বসত। সব বাড়িই যেন একেকটা স্টুডিও। সেখানে চলছে নিরন্তর শিল্পের সাধনা। ‘তালপাতার পটচিত্র এই গ্রামের একটা ঐতিহ্য’- জানালেন এই গ্রামেরই পটচিত্র শিল্পী চন্দন সোঁয়াইন। এমনিতে পুরোনো সুতির কাপড় দিয়ে তৈরি ক্যানভাস, তসরের কাপড়ের ওপর পটচিত্রের চল তো রয়েইছে।
পটচিত্রের এই ঘরানা তো শুরু হয়েছে পাঁচ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কিন্তু, তালপাতার ওপর পটচিত্রের ব্যাপারটা যেমন অভিনব, কাজটা তেমনই কঠিন। গ্রামের মাত্র কয়েকটি বাড়িতেই এর চর্চা রয়েছে। তালপাতার একেকটা পট বানাতে দুমাস থেকে দুবছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। ব়ংশপরম্পরায় এই শিল্পকে বা্ঁচিয়ে রেখেছেন বৃন্দাবন সোঁয়াইন। নিপুণ হাতে তালপাতার পটে ফুটিয়ে তোলেন রামায়ণের কাহিনী, কৃষ্ণলীলা, বিষ্ণুর দশাবতার কাহিনী। তিনি জানালেন পটে শুধু প্রাকৃতিক রঙেরই ব্যবহার হয়—শঙ্খচূর্ণ থেকে সাদা, চারকোল থেকে কালো, লাল রঙের জন্য লাল পাথরের গুঁড়ো আরো সব প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাঁচ রকমের মৌলিক রঙ সংগ্রহ করেন তাঁরা। তারপর সেগুলো মিলিয়ে মিশিয়ে মোট পঁচিশটি রঙ। এখানকার শিল্পীদের কাছ থেকে জানা গেল যে স্নানযাত্রার আগে ভগবান জগন্নাথের জ্বর হয়। সে সময় ভগবানের মূর্তির বদলে এই জগন্নাথের পটচিত্র পূজা করা হয়।
প্রায় কোনও রকম সরকারি সাহায্য ছাড়াই নিজেদের ভালোবাসার তাগিদেই যাঁরা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন । নিজেদের কাজের মূল্য পান না তাঁরা। কাজের সূক্ষ্মতা ও ডিটেইলিং অনুযায়ী পটের মূল্য স্থির করা হয়। চারশো টাকা থেকে শুরু।
তালপাতার পটের দাম হতে পারে ছয় লক্ষ টাকা পর্যন্ত। দেশের বাজারে এই দাম দিয়ে পটচিত্র কেনার মতো শিল্প রসিকের সংখ্যা খুব কম। তাই বিভিন্ন হস্তশিল্প মেলায় বিদেশি ক্রেতারাই শিল্পীদের প্রধান ভরসা। তাই নিতান্তই অভাবে পড়ে পট আঁকা কমিয়ে বাজার চলতি নানান শৌখিন জিনিস পত্র তৈরি করতে হচ্ছে—-এটাই আক্ষেপ চন্দন বাবুদের।