হোমফিচারকুটুমকাটুমের কারখানায়

কুটুমকাটুমের কারখানায়

কুটুমকাটুমের কারখানায়

বর্ণালী জানা বর্ণালী জানা

খেলাচ্ছলে শিল্পসৃষ্টি। জাপানে যেমন অরিগ্যামি, আমাদের তেমনই কুটুমকাটুম। গাছের ডাল, পড়ে থাকা কাঠকুটোকে ভেঙে, জুড়ে নানা রকম বিমূর্ত অবয়ব দিয়েই তৈরি হয় কুটুমকাটুম। এ শিল্প একেবারেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজস্ব, নামখানাও তাঁর দেওয়া। বেঙ্গল স্কুল অফ আর্টের পুরোধা পুরুষ অবনীন্দ্র শেষ জীবনে মেতেছিলেন এই বিচিত্র কুটুম কাটুম তৈরির নেশায়। রেখা, বর্ণ, রূপ—এই তিনের সমন্বয়ে সরল রূপ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন…যার প্রকাশ ঘটেছিল কুটুমকাটুমে।

বাগীশ্বরী শিল্প প্রবন্ধমালাতে তিনি লিখছেন, ‘ সেই বিক্রমাদিত্যের আমলে একটা শুকনো গাছ—মাঠের ধারে সে অপেক্ষা করছিল যে তাকে নিয়ে একটিবার সত্যি সত্যি খেলবে তার জন্য। রাজা গেলেন পথ দিয়ে, দেখলেন শুকনো গাছ। রাজার সঙ্গেই রাজকবি—তিনি কবি নয় কিন্তু পদ্যে কথা বলেন—তিনি পদ্যে বললেন—‘ এ যে দেখি শুষ্ক কাঠ’… একটি ছেলে দেখলে শুকনো কাঠ নয়—সে ঘোড়া মানুষ কত কি? একজন কবি দেখলেন শুকনো গাছ নয়—রসের পাত্র সেটি, ছেলে করে রূপের আরোপ, কবি করেন রূপের আবির্ভাব শুকনো কাঠে’। রূপের মধ্যে অরূপ দেখে তিনি মেতে ওঠেন নতুন শিল্প চর্চায়। কিন্তু তাঁর পরে এই শিল্পধারাকে কারা এগিয়ে নিয়ে গেলেন? ‘এটাকে খুব খুব উঁচু মানের শিল্প বলে মনে করা হয়না। কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে হয়তো এই কুটুমকাটাম তৈরি করেছেন, কিন্তু সেটা কখনোই তথাকথিত শিল্পের পর্যায়ে যায়নি’…জানালেন চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর মন্দিরা ভান্ডারী। তাই নিয়ম করে এই শিল্প চর্চার কোনও রীতি গড়ে ওঠেনি। তবে কি হারিয়ে যাবে বাংলার, বাঙালির এই ঐতিহ্য? এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এক অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে চালচিত্র অ্যাকাডেমি।

কলকাতার এই নন-প্রফিট সংস্থাটি জঙ্গল মহলের লোধা ও শবরদের মধ্যে এই শিল্পকে ছড়িয়ে দিতে এগিয়ে এসেছে। এই সংস্থার হাত ধরে জঙ্গলমহলে ঝাড়গ্রাম শহরের অদূরে শবরদের জনপদ লালবাজারে যে স্বপ্নের শিল্পগ্রাম ‘খোয়াবগাঁ’ গড়ে উঠছে সেখানেই ছেলেবুড়ো সবার মধ্যেই চলছে কুটুমকাটুমের চর্চা। ‘এখানে রসদের কোনও অভাব নেই। চারদিকে গাছপালা। তাই একে একটা লোকাল ক্রাফ্‌ট হিসাবে তুলে ধরার উদ্যোগ নিচ্ছি আমরা। জঙ্গলমহল বলতে লোকে যাতে কুটুমকাটামকেও বোঝে’—জানালেন চালচিত্র অ্যাকাডেমির কর্ণধার মৃণাল মণ্ডল। তাই এই গ্রামে নিয়মিত হয় কুটুম কাটুম ওয়ার্কশপ। জঙ্গল মহলের দুই লোকশিল্পী রামেশ্বর সোরেন ও যজ্ঞেশ্বর হাঁসদা এখানকার ছেলেমেয়েদের শেখান কুটুমকাটামের কৌশল।

গ্রামের ছেলেমেয়েরাও খুব মন দিয়ে শিখছে এই শিল্প। তাদের হাতের কাজ ইতিমধ্যেই বেশ সাড়া ফেলেছে। মাত্র এক বছরে প্রায় ষাট-পঁয়ষট্টিটা কুটুম-কাটাম তৈরি করে ফেলেছে এই গ্রামেরই ছেলে ষষ্ঠীচরণ আহির। পোলিওতে পঙ্গু এই যুবক তার অদম্য মনের জোর নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে শিল্পের সাধনা। বিভিন্ন লোকমেলা ও হস্তশিল্প মেলায় বেশ সাড়া ফেলেছে তার কুটুমকাটাম। এদের হাত ধরেই বেঁচে থাকবে ঐতিহ্যবাহী একটা শিল্প…বেঁচে থাকবে কুটুমকাটাম।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img