হোমফিচারচা-বিলাসী রবীন্দ্রনাথ

চা-বিলাসী রবীন্দ্রনাথ

চা-বিলাসী রবীন্দ্রনাথ

ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার

চা-পান ছিল রবীন্দ্রনাথের অন্যতম বিলাসিতা। প্রতিদিন অন্ধকার থাকতে বনমালীর হাতের তৈরি চা সহযোগেই তাঁর দিন শুরু হত। শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, ঠাকুর পরিবারের নিত্যদিনের মজলিশী আড্ডার অন্যতম অঙ্গ ছিল এই চা-পান। সকলকে চা পানে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে একটা চায়ের আসর গড়েছিলেন যার নাম সুসীম চা-চক্র। এই আসরের একটা ছোট্টো ইতিহাস আছে, আছে নেপথ্যে একটা গানের খবরও ।

1916 সালে জাপান ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ এক ধনী ব্যক্তির বাড়িতে চা-পান অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পান। চা-পান অনুষ্ঠান জাপানের একটি বিশেষ রীতি, যেটিকে জাপানীরা প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সানন্দে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। সেই চায়ের অনুষ্ঠান রবীন্দ্রনাথকে এতই মোহিত করেছিল যে তিনি তাঁর বিস্তৃত বিবরণ লিখেছেন ২২ জৈষ্ঠের লেখায়।

‘তার পরে গৃহস্বামী এসে বললেন, চা তৈরি এবং পরিবেশনের ভার বিশেষ কারণে তিনি তাঁর মেয়ের উপরে দিয়েছেন। মেয়ে এসে নমস্কার করে চা তৈরিতে প্রবৃত্ত হলেন। তার  প্রবেশ থেকে আরম্ভ করে চা তৈরির প্রত্যেক অঙ্গ যেন কবিতার ছন্দের মত । ধোয়া মোছা, আগুনজ্বালা, চা-দানির ঢাকনা খোলা, গরম জলের পাত্র নামানো, পেয়ালায় চা ঢালা, অতিথির সম্মুখে এগিয়ে দেওয়া, সমস্ত এমন সংযম এবং সৌন্দর্য মণ্ডিত যে,  সে না দেখলে বোঝা যায় না।’

1924 সালে  চিন ও জাপান পরিভ্রমণ শেষে দেশে ফিরবার সময়ে রবীন্দ্রনাথ চীন থেকে চায়ের সরঞ্জাম, নানা উপকরণ, চা ও নানা রকম খাবার সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। জাপান ও চীনের বিভিন্ন চা-অনুষ্ঠানে অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনেও একটি চা-সভা স্থাপন করলেন। চিন ভ্রমণের সময়ে সু সীমো নামে যে তরুণ রবীন্দ্রনাথকে দোভাষী হিসাবে সাহায্য করেছিলেন, তার নাম অনুসারে এই চা-সভার নাম রাখা হল সুসীম চা-চক্র। সুসীম চা-চক্রের উদ্বোধনী হয় ২২ শ্রাবণ ১৩৩১ সালে, বর্তমান পাঠভবন অফিসের একতলায় বিদ্যাভবনের লম্বা হল ঘরে। এই উপলক্ষে ওই দিনেই রবীন্দ্রনাথ একটি গান রচনা করেন এবং দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে সমবেত কণ্ঠে সেটি গাওয়া হয়।

হায় হায় হায় দিন চলি যায়।
চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতকদল চল’ চল’ চল’ হে।।
টগ’বগ’-উচ্ছ্বল কাথলিতল-জল কল’কল’হে।
এল চীনগগন হতে পূর্বপবনস্রোতে শ্যামলরসধরপুঞ্জ।।
শ্রাবণবাসরে রস ঝর’ঝর’ ঝরে, ভুঞ্জ হে ভুঞ্জ দলবল হে।
এস’ পুঁথিপরিচারক তদ্ধিতকারক তারক তুমি কাণ্ডারী।
এস’ গণিতধুরন্ধর কাব্যপুরন্দর ভূবিবরণভাণ্ডারী।
এস’ বিশ্বভারনত শুষ্করুটিনপথ- মরু-পরিচারণক্লান্ত।
এস’ হিসাবপত্তরত্রস্ত তহবিল-মিল-ভুল-গ্রস্ত লোচনপ্রান্ত- ছল’ছল’ হে।
এস’ গীতিবীথিচর তম্বুরকরধর তানতালতলমগ্ন।
এস’ চিত্রী চট’পট’ ফেলি তুলিকপট রেখাবর্ণবিলগ্ন।
এস’ কন্‌স্‌টিট্যুশন- নিয়মবিভূষণ তর্কে অপরিশ্রান্ত।
এস’ কমিটিপলাতক বিধানঘাতক এস’ দিগভ্রান্ত টল’মল’ হে।

বাঙালির জীবনে এমন কোনও বিষয় নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া পড়েনি। তাই চা নিয়ে যে এমন একটি মজার গান লিখবেন তাতে অবাক হবার কিছু নেই। গানের মধ্য দিয়ে পূবদেশ থেকে আহূত চায়ের বন্দনার সাথে সাথে চা-চাতকদের আহ্বান করেছেন এই শ্যামলরসধরপুঞ্জে অবগাহন করবার।

তিনি জানতেন চা মন ও শরীরের ক্লান্তি দূর করে। তাই তিনি পুঁথি বিশারদ, গণিতবিদ, কাব্যরসিক, চিত্রকর, বাউণ্ডুলে থেকে শুরু করে এমনকী শশব্যস্ত হিসাবরক্ষকদেরকেও কর্মজীবনের গ্লানি ভুলবার জন্য চা পানে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ বিষয়ে শান্তিনিকেতন পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘পূজনীয় গুরুদেব প্রথমে এই চক্রের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন । প্রথমত, ইহা আশ্রমের কর্মী ও অধ্যাপকগণের অবসরসময়ে একটি মিলন ক্ষেত্রের মত হইবে – যেখানে সকলে এক্ত্র হইয়া আলাপ-আলোচনায় পরস্পরের যোগসূত্র দৃঢ় করিতে পারিবেন।
দ্বিতীয়ত, চিন দেশের চা-পান একটি আর্টের মধ্যে গণ্য। সেখানে আমাদের দেশের মতো যেমন-তেমন ভাবে সম্পন্ন হয় না । তিনি আশা করেন, চিনের এই দৃষ্টান্ত আমাদের ব্যবহারের মধ্যে একটি সৌষ্ঠব ও সুসঙ্গতি দান করবে।’

শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে কবির কোণার্ক বাড়ির লাল বারান্দাটি ছিল চায়ের আসরের জন্য বিখ্যাত। গণ্যমান্য অতিথিদের জন্য প্রায়ই এখানে চায়ের টেবিলের বন্দোবস্ত করতে হত। যেবার জওহরলাল সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে এলেন, উঠেছিলেন এই কোণার্ক বাড়িতে। লাল বারান্দাতেই বসল চায়ের আসর। একবার জাপান থেকে এক অতিথি দম্পতি এলেন আশ্রমে। শুরুদেবকে শ্রদ্ধা জানাতে তারা জাপানি প্রথায় ‘টি সেরিমনি’র আয়োজন করেছিলেন এই লাল বারান্দাতেই। সেদিন অতিথি ভদ্রমহিলা নিজে হাতে জাপানি প্রথায় চা তৈরি করে সকলকে পরিবেশন করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ চায়ের কদর বুঝতেন। চা-পান ছিল তাঁর কাজের অন্যতম সঙ্গী। হয়ত তাঁর অনবদ্য সৃজনশীলতার পিছনেও ছিল চায়ের পরোক্ষ প্রভাব।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img