বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায় ১৯৮০ থেকে ১৯৯২ সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৩ থেকে জনসংযোগ পেশায়। লেখালেখি শুরু বিশ শতকের আশির দশকের গোড়ায়। পদ্য, গল্প, প্রবন্ধ- এই তিনটি ক্ষেত্রে তিনি স্বচ্ছন্দ বেশি। তাঁর আলোড়ন ফেলা বইগুলির মধ্যে রয়েছে অস্তমিত রাজমহিমা(প্রথম খণ্ড), শ্যামপুকুর বাটী ও শ্রীরামকৃষ্ণ স্মরণ সংঘের ইতিহাস, ভারতবর্ষে গন আন্দোলন ও সংবাদপত্রের ভূমিকা ইত্যাদি। বাংলার বিশিষ্ট কবিদের গৃহে কবিতা নিয়ে অনেক আড্ডার সাক্ষী হয়ে আছেন বিশ্বরূপ।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, গত শতকের ষাটের দশক, সাধারণ বাঙালির জীবনে সমস্যা ছিল কিন্তু হাসি আর আনন্দ আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ছিল, পয়লা বৈশাখ মানে হালখাতার দিন বাড়ির বাচ্চারা অপেক্ষা করতো কখন সন্ধ্যা হবে আর বাবা কাকা বা মামার হাত ধরে দোকানে দোকানে যাবে, কারণ গেলেই মিষ্টির বাক্স, সরবৎ এর গ্লাস, আর ক্যালেন্ডার, দোকানদার খুব মন দিয়ে জমা হিসেব লিখতেন , জাঠতুতো খুড়তুতো ভাইরা মিষ্টির বাক্স আর ক্যালেন্ডার এর হিসেবটা মন দিয়ে করে রাখতো, কোথায় গেল সেই সব স্মৃতি আর দিন ?
যে কথা বলছিলামঃ সেই সময় মানে ষাটের দশকে বাংলা নববর্ষের আগে উত্তম সুচিত্রা র সিনেমা চলে আসতো মফস্বল এর হলে , তার আগে উল্টোরথ নবকল্লোলের বিশেষ সংখ্যায় উত্তম সুচিত্রা র লেটেস্ট ছবি ঠাকুরঝি বৌদিদের দেখা হয়ে গিয়েছে, তখন তো গুল কয়লা উনুনের যুগ , সন্ধ্যা বেলা রান্নাবান্না সেরে নাইট শো এ বাড়ির তাবৎ প্রমীলা বাহিনী চিত্র মন্দির সিনেমা হলে; ফেরার সময় ঈষৎ চোখের জল মুছতে মুছতে বাড়ি ফেরা . রাত একটায় খেতে খেতে একেকটা দৃশ্য নিয়ে আলোচনা. আবার কিন্তু পরদিন সকাল ছটায় উনুন ধরানো. মা কাকিমা জেঠিমাদের কখনো ক্লান্ত দেখতাম না. তখন পাড়ার দোকানে বিলিতি পাওয়া যেত, নববর্ষের দিন রসিক বাঙালি চুপিচুপি বিলিতি র স্বাদ নিত আবার আর এক দল বাঙালি সিদ্ধির সরবৎ খেয়ে এ ওর ঘাড়ে গড়িয়ে পড়ত, ওই যে বলছিলাম খুব বেশি চাহিদা তখন বাঙালি জীবনে ছিল না. কিন্তু আনন্দ রসিকতা বঙ্গ জীবনের অঙ্গ ছিল…
তো সেই ষাটের দশকের প্রথমার্ধে দু-দুটো যুদ্ধ বাঙালি জীবনে বেশ নাড়া দিয়েছিল. প্রথমে চীন-ভারত যুদ্ধ, তারপর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, বড়দের মুখচোখ দেখে বুঝতে পারতাম. আবেগ আর দেশভক্তির জোয়ার এসেছিল, যুদ্ধে শহীদ তরুণ অভিজিত্ চৌধুরীর কথা সদর মফস্বল শহরে লোকের মুখে মুখে ফিরত, আকাশবাণীর খবর তখন আপামর বাঙালির নিত্য সঙ্গী, কারণ খবরের কাগজ তো পরদিন সকালে, সাধারণ মানুষ সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছে, বড়রা বলতেন বাজারে আগুন লেগেছে, শহরের বড় রাস্তায় মিলিটারি ভারী ট্রাক এর নিত্য আনাগোনা, সেই প্রথম ব্ল্যাক আউট স্বচক্ষে দেখা, সব থেকে বেশি উত্তেজনা ছোটদের. আকাশে যুদ্ধ বিমানের চক্কর, প্রতিদিন ই নিত্য নতুন গুজব ছড়াত, গুজব ছড়ানোর আখড়া ছিল পাড়ায় পাড়ায় চায়ের দোকান, বড়রাই বলতেন, তবে চারদিকে যাই ঘটুক সাধারণ বাঙালি এই যুদ্ধ টুদ্ধ নিয়ে বেশ মেতে ছিল, মাঝে মাঝে সিনেমা হলের নাইট শো বন্ধ থাকতো, সকাল ন’টার সাইরেন ও সেই সময় শুরু হয়, রেশনের চালে কাঁকর থাকতো আর সেটা বাছার দায়িত্ব ছিল বাড়ির ছোটদের, পাউরুটিরও বেশ আকাল দেখা দিয়েছিল, ফলে পাড়ার লোকাল বেকারিতে সক্কাল সক্কাল লাইন দেওয়ার ডিউটিটাও ছিল বাড়ির ছোটদের. এইসব নিয়ে বাঙালি জীবন তার মতন করে চলছিল…
তা সেই ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ ও সমান ঘটনাবহুল.. ছেষট্টি র গোড়াতেই বাংলা জুড়ে খাদ্য আন্দোলন, কৃষ্ণনগর এ আনন্দ হাইত, অর্জুন বিশ্বাস, বসিরহাট এ নুরুল ইসলাম প্রমুখ ছাত্ররা শহিদ হয়ে গেলেন । ক্লাস ফোর এ তখন পড়ি, তেসরা মার্চ.. স্কুল ছুটির পর আমি আর প্রবীর( এখন নামী ডাক্তার) বাড়ি ফিরছি, হাতে স্কুলের বইখাতা র টিনের বাক্স, পোস্ট অফিস এর মোড় পেরিয়ে দেবনাথ স্কুলের সামনে, হঠাৎ পরপর কিসের একটা শব্দ, পিছনে কে একটা বলল পোস্ট অফিস এর মোড় এ গুলি চলছে, দৌড়াও,ব্যস দুজনে রামছুট দিয়ে সোজা বাড়ি । সেই প্রথম রাস্তায় সিআরপি র ভারী বুটের শব্দে টহল দেখলাম । তারপর দুদুটো যুক্তফ্রন্ট সরকার এবং তার পতন.. বড়দের মুখচোখ দেখে উত্তেজনা র আঁচ পেতাম, মনে আছে সেই সময় অধুনালুপ্ত বসুমতী পত্রিকা ও বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় এর লেখা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল । ঊনসত্তর এ চোখে পড়ত স্কুলে স্কুলে টিফিন টাইমে অচেনা তরুণদের আনাগোনা, টেন-ইলেভেন এ পড়া দাদাদের নিয়ে মৃদুস্বরে আলোচনা, বড়দের মুখে শুনতাম ‘বসন্তের বজ্রনিরঘোষ’ ,একদল তরুণ নাকি গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার স্বপ্ন দেখছে । যাইহোক ঊনসত্তর-সত্তর বেশ টালমাটাল গেল, বোমা আর গুলি র শব্দ, একের পর এক মানুষের খুন হয়ে যাওয়া নিত্য দিনের বিষয়-আলোচনা হয়ে দাড়িয়ে ছিল । স্কুলে স্কুলে পরীক্ষা বন্ধ, ছাত্র ছাত্রীরা বিনা পরীক্ষাতেই উপরের ক্লাস এ উঠে যাচ্ছে । প্রবীণদের দেখে বুঝতে পারতাম তাঁদের মন ভালো নেই । এরই মধ্যে শহরে বিদেশি হিপিদের আনাগোনাও বেড়ে গেল, সে এক অদ্ভুত সময়…
ষাটের দশকে বেশ কয়েকটি মৃত্যু দেশ ও জনজীবনকে বেশ নাড়িয়ে দিয়েছিল.. বড়দের কথাবার্তা শুনে যা বুঝতাম.. প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, বাংলার রূপকার ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, তাসখন্দে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু, রাষ্ট্রপতি জাকির হোসেন এর মৃত্যু.. যা শুনতাম তাইহোকুতে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর বিমান দুর্ঘটনার মতো লালবাহাদুর শাস্ত্রী র মৃত্যুও দেশবাসী মেনে নিতে পারে নি.. যেমন সাধারণ মানুষ পছন্দ করেন নি দেশজুড়ে নেহরু র চিতাভস্ম ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি, অনেকে বিশ্বাস করতেন তারপর থেকেই নাকি দিনকাল খারাপ হতে শুরু করে.. বড়রা বলতেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের মৃত্যু বাংলা র খুব ক্ষতি করে দিল,যাইহোক এই ষাটের দশকেই ইন্দিরা গান্ধীর উত্থান, বিদেশে ভারতের সমীহ আদায় শুরু হল, যা শুনতাম সাধারণ মানুষ ইন্দিরা গান্ধী কে পছন্দ করতে শুরু করেছেন.. কিছু পদক্ষেপ তিনি নিলেন যেমন বাঙ্ক জাতীয়করণ, কয়লা খনি রাষ্ট্রীয়করণ ইত্যাদি.. ভি ভি গিরি কে রাষ্ট্রপতি করে নিজের দলের বর্ষীয়ান নেতাদের চমকে দিলেন, শুনতাম বামপন্থীদের একাংশও তাঁকে পছন্দ করতে শুরু করেছেন, 71 এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য ‘ আখ্যা পেয়ে গেলেন..ঊনসত্তর-সত্তর এ নকশাল আন্দোলন তীব্র আকার নিয়েছিল, বড়দের মুখে শুনতাম মনীষীদের মূর্তি ভাঙা,স্কুল-কলেজে বোমাবাজি, নিরীহ কনেস্টবল-মানুষ খুন, সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয় নি, আবার বড়দের মুখে এও হাহুতাশ শুনতাম অসংখ্য মেধাবী ছেলেমেয়ে নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়ে বেঘোরে প্রাণ দিচ্ছে.. এইরকম নানান টানাপোড়েন এর মধ্যে দিয়ে বছরগুলো যাচ্ছিল…
ষাটের দশকের শেষ দিকে সেই টানা পোড়েনের সময় বাংলা ছায়াছবির জগতে আলোড়ন ফেলল তপন সিংহের ‘ আপনজন ‘ .. পাড়ায় দাদাদের মুখে রবি-ছেনো’র ডায়ালগ, শেষ দুপুরে মা-জেঠিমাদের খাওয়ার আসরে, সন্ধ্যাবেলা বাইরের ঘরে কাকাদের চায়ের আড্ডায় একটাই আলোচনা আপনজন, তার আগে তপন সিংহ মহাশয়ের ‘সাগিনা মাহাতো ‘ তুমুল আলোচনা হয়েছিল, কিন্তু আপনজন সবকিছু ছাপিয়ে যায়, সেটা বুঝতে পারছিলাম বড়দের আলোচনায় , তবে সেই সময় আমাদের ছোটদের কাছে এক আশ্চর্য ছবি হাজির হয়েছিল.. গুপী গাইন বাঘা বাইন.. তবে ছোটদের সঙ্গে বড়রাও এই আশ্চর্য ছবির আনন্দে সামিল হয়েছিল । বড়দের কথাবার্তায় বুঝতাম বাংলা ছবিতে উত্তম-সুচিত্রা জুটির জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে, হিন্দি সিনেমায় রাজেশ খান্না- শর্মিলা ঠাকুরের জুটি জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে দিলীপ কুমার-সায়রাবানু জুটি র পর.. আমাদের সহকর্মী সবার প্রিয় সতীনাথদা (প্রয়াত সতীনাথ চট্টোপাধায়) খুব বলতেন ষাটের দশক বাংলা-হিন্দি গান এর স্বর্ণযুগ.. হেমন্ত, সন্ধ্যা, মান্না, রফি, কিশোর, আশা, লতা..উজ্জ্বল নক্ষত্রের ছড়াছড়ি.. আসলে নদী যেমন তার নিজস্ব গতিপথে এগিয়ে চলে,শিল্প, গান, ললিতকলা, ভাস্কর্যও তাই , চারপাশে যত অশান্তি – সমস্যা থাকুক না কেন.. তাই সাধারণ বাঙালির জীবন তার মতন করে চলছিল…
ষাটের দশকে দেখেছি প্রায় সব বাড়িতেই সকাল ছ’টায় রেডিও চালু হয়ে যেত, তখন বিখ্যাত সব কোম্পানির বড় বড় রেডিও, বিদ্যুত এ চলত, ট্রানজিস্টার জনপ্রিয় হতে শুরু করল ষাটের দশকের শেষ দিকে, এখনও মনে আছে রমেশ জাঠামশাইয়ের বাড়িতে রেডিও সবসময় জোর ভলিউম এ খোলা থাকতো .. ‘ আকাশবাণী, খবর পড়ছি বিভূতি দাশ..’ গমগমে গলায় সকালের খবর ভেসে আসতো ।সেইসময় রেডিও বা ট্রানজিস্টার ছিল বাঙালির নিত্য সঙ্গী, ইডেনে টেস্ট খেলা বা ফুটবল.. অজয় বসু, কমল ভট্টাচার্য, পুষ্পেন সরকার মহাশয়রা সাধারণ বাঙালির রান্নাঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন । জাঠা-কাকাদের সঙ্গে মা-জেঠিমারাও খেলার উত্তাপ উপভোগ করতেন, বেশ মনে আছে । আসলে সাধারণ বাঙালির জীবনে খুব বেশি চাহিদা তখন ছিল না । মফস্বল শহরে সেই সময় মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল এর খেলা মানেই ঘটি-বাঙাল এর মজার লড়াই, এ বাড়িতে ইলিশ তো ও বাড়িতে চিংড়ি, আমরা ছোটরা দেদার মজায় থাকতাম। তখন ছোটদের হাতে পয়সা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না, একমাত্র চৈত্রের শেষে রাজবাড়ির মাঠে বারোদোলের মেলার সময় বড়দের কাছ থেকে পার্বণি জুটত, সেইটাই সারাবছর যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখে স্কুলের পিছনের গেটে হীরালাল এর কাছে পাঁচ বা দশ পয়সার আইসক্রিম কিংবা ঘুগনি-আচারের স্বাদ মিলত। রেডিও ও আকাশবাণী দিয়ে শুরু করেছিলাম, বড়রা অফিস-কাছারিতে বেরিয়ে গেলে অনেক বাড়িতেই কিন্তু বিবিধ ভারতী বা সিলোন বেতারের অনুষ্ঠান চালু হয়ে যেত । প্রসঙ্গত জানাই, এই অধম আজও সকালে আকাশবাণী দিয়ে দিন শুরু করে কর্মক্ষেত্রে বেড়িয়ে যাওয়া পর্যন্ত, সন্ধ্যায় ফিরে এসে আবার সেই আকাশবাণী.. প্রেম যে সেই শৈশব থেকে, কি আর করা যাবে!
ষাটের দশকের আরও দু-চারটি কথা .. সেই সময় সব বাড়িতেই রান্না হত কয়লার উনুনে ,সঙ্গে থাকত গুল, ঠাকুমা-পিসীরা কাঠের তক্তায় নিপূণভাবে বড় রাজভোগের মতো গুল তৈরি করে রোদে শুকোতে দিতেন ।সব বাড়িতেই একটা নির্দিষ্ট জায়গা থাকত যেখানে বিহারী মুটেকাকুরা বাঁকে করে কয়লা নিয়ে এসে ঝপাস করে কয়লা ফেলে দিতেন । কয়লার ডিপোতে অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখতে হত । সব বাড়িতেই রেডিও চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উনুন ধরানো হত । মা কাকিমা জেঠিমা দের রান্না-খাওয়ার পাট চুকতে চুকতে আড়াইটে-তিনটে, আবার চারটে বাজতে না বাজতেই আবার উনুন ধরানোর পালা, সন্ধ্যার জলখাবার, রাতের খাবার । তখন সব বাঙালি বাড়িতেই দুপুর বা রাতের খাবার এ ভাজাভুজি ও আমিষ নিয়ে চার পাঁচটি পদ হতই, তা নাহলে বাড়ির কর্তাদের মুখে ভাত রুচতো না। তা সেই ষাটের দশকের মাঝামাঝি কয়লারও আকাল দেখা দিল, কয়লার ডিপোতে রেশনিং চালু হয়ে গেল । পাড়ার চায়ের দোকানে একটাই আলোচনা- কি আকালের দিনই পড়ল! তখন একটা জিনিস দেখেছি অধিকাংশ মানুষের খুব বেশি উচ্চাশা বা সুখে থাকার অভিলাষ ছিল না.. ছেলেপুলে পাশটাশ করে মফস্বল শহরেরই স্কুল-কলেজ, কোর্টকাছাড়ি, কালেক্টরি, সেটলমেন্ট অফিস, নিদেনপক্ষে মিউনিসিপ্যালিটিতে এ একটা চাকরি জুটিয়ে নেবে, ব্যস তারপর বিয়ে দিয়ে দিব্বি ঘর-সংসার । নতুন বৌ এসে সকাল ছটায় শাশুড়ির সঙ্গে উনুন জ্বালাবে, আর কি চাই.. এই তো জীবন, থোড়বড়ি খাড়া, খাড়া থোড়বড়ি.. আনন্দের মিশেল ছিল পাড়ার সিনেমা হলে উত্তম সুচিত্রা র লেটেস্ট ছবি আর রবীন্দ্রভবনে বহুরূপী-নান্দীকারের নাটক, খুশি ছিল এক্কেবারে সাধারণ বাঙালি । আমাদের পাড়ায় সবাই মেজদা বলে ডাকত, সেই তিনি রোজ বাড়ি ফিরতেন ঠিক রাত বারোটায়, ঈষৎ কিংবা একটু বা বেশি রসেবসে হয়ে.. তাঁর একটাই ডায়ালগ ছিল.. এই তো জীবন, সব্বাই ভালো থাকো বাওয়া.. এখন এই ষাট পার করে বুঝি ভালো থাকাটা সবথেকে জরুরি …
সেই সময় পুজো পুজো গন্ধটা নিয়ে আসতো উঠোনে শিউলি গাছতলায় ছড়িয়ে থাকা শিউলি ফুলের ম ম করা গন্ধ আর পাড়ার বারোয়ারিতলায় দেবীর কাঠামোয় মাটির প্রলেপ । আর ঠিক সেই সময় বাড়ি বাড়ি দিয়ে যেত বাটা কোম্পানির সুদৃশ্য রঙিন পুস্তিকা ‘ পুজোয় চাই নতুন জুতো ‘ .. উফ্ !স্কুলে যাওয়ার আগে আর ফিরে কতবার যে ঐ ছোট বইটার গন্ধ শুঁকতাম.. ছোটদের কপালে অবশ্য সেই নটি বয়, সহজে নষ্ট হওয়ার নয়, বেশ টেকসই, আমরা অবশ্য তাতেই ঢের খুশি, ছোটকাকা কিনে নিয়ে আসতেন এইচ এম ভি ‘র শারদ অর্ঘ্য, পুজোর যত গান..সেইসঙ্গে ছিল স্কুলে যাওয়া আসার পথে বারোয়ারিতলা অন্তত একবার ঢুঁ মারা । তখন সব বাড়িতেই দেখতাম পুজোর একমাস আগে কলিচূণ আর রঙের প্রলেপ পড়ত, দরজা জানালায়, কড়ি বরগায় আলকাতরা, ঘুণ নাকি ধরে না ! বেলপুকুর গ্রাম থেকে ভাগচাষি এসে জাঠা কাকাদের কাছে এসে ফসল এর হিসেব দিত , বস্তায় করে ঢেঁকিতে ছাঁটা চাল নিয়ে আসতো.. এখনও মনে আছে লাল চালের ভাত, সেই ভাতের ফেন মা জেঠিমারা ছোটদের জোর করে খাওয়াতো সুস্বাস্থ্যের উদ্দেশ্যে । দেখতে দেখতে বিশ্বকর্মা পুজো চলে আসতো, সতেরোই সেপ্টেম্বর, একদম বাঁধা দিন, সকলেরই মনে থাকতো.. আর তারপরেই তো সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের অবিস্মরণীয় মহালয়া.. সব বাড়ির কর্তাদের প্রধান কাজ ছিল রেডিওটা ঠিক আছে কিনা দেখে নেওয়া । পুজোর ঠিক আগে আকাশবাণীতে রবিবার দুপুরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের একটা হাসির নাটক হতই.. পুজোর বোনাস.. বাড়িশুদ্ধ সব লোক শুনবেই । অবশ্য ততদিনে ছোটদের জন্য শারদীয়া শুকতারা, বাড়ির মহিলা মহলের জন্য নবকল্লোল, উল্টোরথ চলে এসেছে .. ও: উত্তম সুচিত্রা র লেটেস্ট ছবি দেখার জন্য ঠাকুরঝি বৌদিদের সে যে কি হুমড়ি খেয়ে পড়া.. আমরা ছোটরা চুপিচুপি হাসতাম । আর একটা কথা বলা হয় নি .. পুজোর কিন্তু দু-আড়াই মাস আগে শান্তিপুর , ধনেখালি থেকে মাথায় কাপড়ের গাঁটরি নিয়ে হাজির হত সেই আজ হারিয়ে যাওয়া ফেরিওয়ালার দল, দুপুর দুটো-আড়াইটে, কর্তারা যেযার কর্মক্ষেত্রে, ছোটরা স্কুলে, বাড়ির বাইরে ঘেরা বারান্দায় ফেরিওয়ালা কাপড়ের গাঁটরি খুলে বসত, পানের বাটা নিয়ে বাড়ির গিন্নিমা, সঙ্গে ঠাকুরঝি বৌদিদের দল, এবং অবশ্যই নিমাইয়ের মা.. তার মতামতকে গিন্নিমা যথেষ্টই গুরুত্ব দিতেন, কাপড় বাছাইপর্বের কাজ শেষ হতে হতে সেই সাড়ে চারটে পাঁচটা । কর্তাদের, ছোটদের ফেরার টাইম হয়ে যেত । তবে বাড়ির ছোট মেয়েদের কালিকো কোম্পানির কাপড়ের ফ্রক, আর ছোট ছেলেদের জামা, ফলে পুজোর ক’দিন কোন বাড়ির ছেলেমেয়ে তা ঐ জার্সিতেই বোঝা যেত । দেখতে দেখতে পুজো চলে আসতো, সপ্তমী-অস্টমী থেকেই নারকোল কুঁড়ে নাড়ু বানানোর পর্ব শুরু হয়ে যেত.. বলতে ভুলে গেছি মহালয়ার ঠিক আগেই নারকোল গাছ ঝারানিরা এসে নারকোল পেরে দিয়ে গাছ পরিষ্কার করে দিত, সেইসঙ্গে ইঁদারায় নেমে পরিষ্কার করে দিত । তখন মফস্বলের সব বাড়িতেই ইঁদারা বা কুয়ো থাকতো । নবমীর দিন ময়দা বেলে নিমকি ভাজা শুরু হত, বনস্পতি ডালডা দিয়ে, সেই ডালডা আজ কোথায়? বাঙালি আজ ভয় পায়, তার ঘরে আজ রিফাইন্ড সাদা তেল.. যাইহোক মা জেঠিমা দের সাথে কাকারাও হাত লাগাতেন.. অবশ্য নবমী থেকেই বাঙালির মন খারাপ শুরু হয়ে যেত! দশমীর দিন হত ঘুগনি । সন্ধ্যাবেলা প্রতিমা নিরন্জনের পর বাড়ি বাড়ি প্রণাম ও কোলাকুলি পর্ব শুরু হত । সেই পুজো, সেই বিজয়া দশমী র আনন্দ আজ কোথায়? কেন জানি না ইদানীং খুব মনে হয় হারিয়ে গেছে বাঙালির সেই বিজয়া দশমী, সেইসঙ্গে বাঙালির প্রাণপ্রতিমাও…
তা সেই সময় সব সাধারণ বাঙালি বাড়িতেই কাঁসার বাসনের চল ছিল.. স্টেইনলেস স্টিলের বাসন ঢুকলো সত্তরের দশকের মাঝামাঝি.. কাঁসার থালায় ভাত, লবণ, লেবু, লঙ্কা, কাঁসার বাটিতে ডাল, সব্জি, মাছ বা অন্যান্য আমিষ পদ, একমাত্র অম্বল, চাটনি বা দই দেওয়া হত কাঁচের অথবা চীনা মাটির বাটিতে । কাঁসার থালাবাসনে বাড়ির কর্তাদের বা ছোটদের নাম লেখা থাকত। কাঁসার দোকানেই নাম খোদাই করার লোক থাকতো । একমাত্র বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হলে সে ছোটখাটোই হোক বা বড় কলাপাতায় খাওয়া আর মাটির গ্লাস এ জল, এবং জলে কর্পূর দেওয়া থাকতো । যেটা দেখেছি বাড়ির মহিলাদের প্রসাধন বলতে আফগান স্নো, কিউটিকুরা পাউডার, মাথায় মাখার জন্য কান্থারাইডিন তেল বা কেয়োকার্পিন, গায়ে মাখার সাবান মলয়চন্দন এবং অবশ্যই বঙ্গ জীবনের অঙ্গ বোরোলীন। শীতকালে তুহিনা ,ভেসলিন । কর্তারা পছন্দ করতেন মাথায় মাখার জন্য জবাকুসুম তেল। রবিবার বাড়ির সকলের মাথাঘষা পর্ব চলতো রিঠে ভেজানো জলে । তখনও সার্ফ বা জেন্টিল সেভাবে ঢোকে নি, ফি রোববার সব বাড়িতেই সোডা দিয়ে কাপড় সেদ্ধ করে কাচা হত । ভালো জামাকাপড় যেত পাড়ার লন্ড্রিতে । বাড়িতে নববধূর আগমনের পর সেই নবদম্পতির বিলাসিতা ছিল বাড়ির কর্তাদের অনুমোদন নিয়ে কলকাতায় গিয়ে শিয়ালদহ স্টেশনের নেমে বারন্সে, অথবা কলেজ স্ট্রিট এ দিলখুশায় বা আমিনিয়ায় খাওয়া আর ছবিঘর, পূরবী বা ধর্মতলায় মেট্রোয় সিনেমা দেখা । ফিরে এসে বন্ধুদের কাছে সেই গল্প সাতদিন ধরে চলত । এইসব ছোটখাটো সুখ নিয়ে সেই সময়ের বাঙালি বেশ আনন্দেই ঘর-সংসার করত । মনে আছে, পাড়ারই এক নবদম্পতি হনিমুনে গোয়ায় গিয়ে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল । বড়দের কথা বার্তায় যা বুঝতাম সঙ্গম, এন ইভনিং ইন পারিস, আরাধনা র মতো হিন্দি সিনেমার প্রভাব বাঙালি জীবনে ঢুকতে শুরু করেছে…
আগামীকাল এবারের সাধারণ নির্বাচনের সপ্তম ও শেষ দফা ভোট । কিছু কথা মনে পড়ছে, 1967 সালে ভোট ঘিরে তুমুল উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল । তখন স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ি । বড়দের কথাবার্তায় যা বুঝতাম কংগ্রেস এর জেতার কোন সম্ভাবনা নেই । এবং সেটাই হল, প্রবল উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন হল । মনে আছে সেদিন সন্ধ্যায় সব বাড়িতে প্রদীপ বা মোমবাতি জ্বালিয়ে আনন্দ উৎসব পালন করা হয়েছিল । এবং কিছু অত্তুৎসাহী লোকজন কংগ্রেসিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে এসেছিল । ঠিক এইরকম আরেকটা অকাল দীপাবলির পরিবেশ তৈরি হয়েছিল 16 ডিসেম্বর, 1971,প্রতিবেশী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের পর। যাইহোক , সেই সরকার বেশি দিন টিঁকলো না। 1969 এ দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন হল । কিন্তু সেই সরকারও বেশি দিন টেঁকে নি। যা বুঝতাম, যা শুনতাম বাজারদর সাধারণ বাঙালি র আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে । আর তারপরেই এল নকশাল আন্দোলন যা তীব্র আকার ধারণ করল অচিরেই । এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে 1970 এর নভেম্বর এ কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পূজার ভাসান চলছে, পোস্ট অফিস এর মোড় এ বড়দের সঙ্গে আমরা ছোটরাও ভাসান দেখছি । এক সুদর্শন তরুণ আমার এবং পিসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে ভাব জমালেন । শহরের নানান কথা জিজ্ঞেস করছিলেন.. আমরাও আমাদের মতো করে উত্তর দিচ্ছিলাম। কথায় কথায় জানলাম ঐ তরুণ প্রেসিডেন্সি কলেজ এ পড়েন। আরো পরে আমার এক কাকার কাছ থেকে জেনেছিলাম ঐ তরুণ প্রেসিডেন্সি তে অসীম চট্টোপাধায় এর নেতৃত্বাধীন প্রেসিডেন্সি কনসোলিডেশনের একজন সক্রিয় সদস্য । যথারীতি আমাদের বাড়ির গুরুজনেরা এই ধরনের তরুণদের সঙ্গে মিশতে আমাদের ছোটদের পই পই করে বারণ করে দিয়েছিলেন । সেই সময় সাধারণ বাঙালিদের মধ্যে প্রেসিডেন্সি কলেজ নিয়ে যথেষ্টই সমীহ ছিল ।
1971 সালটা ছিল এইরকম.. প্রতিবেশী রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তান এ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, আর এদিকে তীব্র নকশাল আন্দোলন । সীমান্তবর্তী জেলা শহরটির পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা অসংখ্য শরণার্থীর চাপে নাভিশ্বাস ওঠার মতো অবস্থা । আকাশবাণীতে মুক্তিযুদ্ধের খবর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে পরিবেশন করে দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় মহাশয় তখন আপামর বাঙালি র জনপ্রিয় মানুষ । আমার ছোটকাকা খুব মজা করে বলতেন, কে বেশি হিরো রে ? মুজিবুর রহমান না দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় ? যাইহোক, চারপাশে যাই ঘটুক,
নানারকম অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে বছরগুলো যাচ্ছিল…