হোমফিচারপ্লেগ থেকে করোনা-কাকতালীয় নাকি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?

প্লেগ থেকে করোনা-কাকতালীয় নাকি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?

প্লেগ থেকে করোনা-কাকতালীয় নাকি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?

বর্ণালী জানা বর্ণালী জানা

অবরুদ্ধ নগরী। অঘোষিত কার্ফু। পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন শহর । শহরের সীমায় দাঁড়িয়ে সশস্ত্র বাহিনি। শহর ছেড়ে কারো পালানোর উপায় নেই। যারা কিছুদিনের জন্য বাইরে গিয়েছিলেন তাঁদেরও আর ফেরার পথ নেই। প্রিয়জনেদের সঙ্গে আর দেখা হবে কিনা তাও জানা নেই। শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে মড়ক…প্রাণঘাতী প্লেগ। পাইকারি হারে লোক মরছে প্রতিদিন। কবর দেওয়ারও কেউ নেই। স্রেফ গর্ত খুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে লাশগুলো। এই মহামারীকে রুখতে অসম এক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার বাবু। তাঁর স্ত্রীও বাইরে। আর ফিরবেন কিনা জানা নেই। অবরুদ্ধ নগরীর বাসিন্দাদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে মানসিক বিকার। বন্দী জীবন কাটাতে কাটাতে একেকজন হয়ে উঠছে জ্যান্ত লাশ। তাও মানুষের লড়াই চলছে। আলজিরিয়ার এক শহরের এই মর্মস্পর্শী ছবি এঁকেছিলেন আলবেয়ার কামু…তাঁর ‘প্লেগ’ উপন্যাসে। আজ ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে এই ছবিটা পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে না? শুধু প্লেগের বদলে করোনা।  লেখকরা কি তবে ভবিষ্যতদ্রষ্টা?

সারা বিশ্বের মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত। এই রোগের কোনও প্রতিষেধক নেই। তাই মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। এ পর্যন্ত এই রোগের কবলে ১৩ হাজারেও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। চিন থেকে ভাইরাস ছড়িয়েছে ইউরোপে, আমেরিকায়। বাদ যায়নি ভারতও। ইতালির অবস্থাই সবচেয়ে শোচনীয়। মৃতের সংখ্যা এখানে ৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। পুরো দেশ অবরুদ্ধ। পথঘাট খাঁ খাঁ। প্রতিদিন মরছে শয়ে শয়ে মানুষ। রোগের কাছে একটা প্রথম বিশ্বের দেশও কতটা অসহায়! ভারতে জনতা কার্ফুর পর এবার লকডাউন। পরিস্থিতি ক্রমের হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে।

তাহলে আবার কি সেই ‘প্লেগ’ এর পুনরাবৃত্তি। কথায় বলে হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ। বিভিন্ন মহামারীর ক্ষেত্রে এমনটাই দেখা গেছে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে প্রতি একশো বছর অন্তর পৃথিবীতে আসে এমন মহামারী…যেমনটা এসেছিল ১৩২০ সালে, ইউরোপ আর এশিয়ায়। একে বলা হয় ‘ব্ল্যাক ডেথ অফ বুবনিক’। এই মহামারিতে ২০ কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।

এরপর ১৪২০। ঠিক একশো বছর পর। রোমে ছড়িয়ে পড়ে ‘দ্য এনডেমিক অফ ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ’। কয়েক মাসের মাসের মধ্যে প্রায় দশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়।

সময়টা ১৫২০। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে থাবা বসায় প্রাণঘাতী স্মল পক্স। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ৮০ হাজার মানুষ। ১৬২০ তে লন্ডনে আসে নতুন মহামারী ‘মে ফ্লাওয়ার’। স্মল পক্স, টাইফাস, ইনফ্লুউয়েঞ্জা…এমন সব অজানা জ্বরে শ্মশানে পরিণত হয় লণ্ডন। ১৭২০-তে ‘দ্য গ্রেট প্লেগ অফ মার্সেই’। ভয়াল এই প্লেগ প্রাণ নিয়েছিল ফ্রান্সের ১০ লক্ষ মানুষের। তারপর আবারও প্লেগ। ১৮২০ সালে। ভারতে কলেরা আর আমেরিকায় ইয়েলো ফিভারে মারা যায় লক্ষ লক্ষ মানুষ। ১৯২০ সালে আসে ‘দ্য স্প্যানিশ ফ্লু’। থাবা বসায় স্পেনে।

এছাড়াও, মড়কের আরো অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। কলকাতাতেও হানা দিয়েছিল প্লেগ। সেটা ১৮৯৯ সাল। নিজের জীবনের পরোয়া না করে আর্তের সেবায় নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন সিস্টার নিবেদিতা। কলকাতা শহর প্রায় উজাড় হতে বসেছিল। ঠাকুর বাড়িতেও ছোবল বসিয়েছিল এই রোগ। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর হারিয়েছিলেন তাঁর ছোট কন্যাকে। আর এ বাংলায় ম্যালেরিয়া আর কালোজ্বরে যে কত মানুষের প্রাণ গেছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। পঞ্চাশের মন্বন্তরকেও কি মহামারী বলা যেতে পারে? মনুষ্যসৃষ্ট মহামারী?

আবার এসেছে এই কালো দিন। সারা পৃথিবীর ওপর করোনার করাল ছায়া। তবে মানুষের অদম্য প্রাণশক্তির কাছে এই রোগ একদিন হার মানবে এমনটা আশা করি। করোনার আতুঁড়ঘর চিনে করোনার প্রকোপ কমে এসেছে। বাকি পৃথিবীও হয়তো এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠবে। কবি তো বলেই গেছেন ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি’। তবে এতে আত্মসন্তুষ্টির কোনও অবকাশ নেই।

আলজিরিইয়ার সেই কাল্পনিক শহরেও প্লেগ প্রতিরোধ করা গিয়েছিল। আনন্দে মেতে উঠেছিলেন শহরবাসী। রেস্তোরাঁর, কাফেতে তাঁরা ভিড় জমিয়েছিলেন। কিন্তু এই স্বশ্তির মধ্যেও এক অশনি সংকেত দেখেছিলেন ডাক্তার বাবু। আনন্দে মত্ত এই জনতা জানে না প্লেগ ব্যাসিলাস মরে না…ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে যায় না। আমাদের পরিবেশেই বছরের বছর সে সুপ্ত থাকে। মানুষের প্রাণশক্তির প্রমাণ নিতে আবার সে কোনও একদিন জেগে ওঠে। শুরু হয় নতুন মড়ক…যেমনটা হয়ে এসেছে এতদিন।

করোনার ভয়াবহতাও একদিন কমবে। কিন্তু আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে আগামী দিনের জন্য।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img