বর্ণালী জানা
খবরটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বভারতীতে উপাসনা হল রবীন্দ্রসঙ্গীতের হিন্দি অনুবাদের মাধ্যমে। কারণ হিসাবে বলা হল, উপসনায় যিনি আচার্যের দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি নাকি বাংলা বোঝেন না। তাই বিশ্বভারতীর এতদিনের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি জলাঞ্জলি দিয়ে হিন্দিরই জয়। একে কি হিন্দি ভাষার আগ্রাসন বলব? স্বাধীনতার পর থেকেই তো এই আগ্রাসন চলছে… উত্তর ভারতের কিছু কায়েমী স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতার চক্রান্তে ভারতের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বহুত্বকে করে নস্যাৎ করে সবার ওপর হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়ার একটা জঘন্য খেলা শুরু হয়েছে। দেশের সংবিধানের অষ্টম তপশিলে জাতীয় ভাষা হিসাবে দেশের বাইশটি ভাষাকে সম মর্যাদা দেওয়া হলেও হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা চলছে। এ নিয়ে দেশজুড়ে অসন্তোষও তৈরি হয়েছে।
সেবার কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের এক সভা। বাঘা বাঘা বক্তারা সব বলবেন ইংরেজিতে। দেশের রাজনীতির অত গুরুগম্ভীর বিষয় বাংলায় বলা যায় নাকি? সভায় উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অক্লান্তভাবে বক্তাদের সব কথা বাংলায় তর্জমা করে বাংলায় শুনিয়েছিলেন শ্রোতাদের। নিজের ভাষার সম্মান রক্ষায় তাঁর কোনও ক্লান্তি ছিল না। আজ তাঁরই গড়া প্রতিষ্ঠানে বাংলার এই অবমাননা।
স্বাধীনতার পর তেলুগুভাষী অঞ্চলগুলিকে নিয়ে একটি পৃথক রাজ্য গঠনের দাবিতে অনশন শুরু করেছিলেন পট্টি শ্রীরামালু। অনশনে মৃত্যু হয় তাঁর। তারপর থেকেই ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠনের তোড়জোড়। ১৯৫৬ সালে পাশ হল রাজ্য পুনর্গঠন আইন। কিন্তু তারপরেও কেন হিন্দির এই আগ্রাসন? দেশের মানুষের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র উদযাপন করার মধ্যেই তো একটা রাষ্ট্রের সাফল্য। কিন্তু আজ যখন বিভিন্ন এফ এম চ্যানেলের জকিদের বলতে শুনি… ‘ভোট করুন’ কিংবা রাস্তার হোর্ডিং-এ দেখতে পাই… ‘সীমাহীন কল প্রাপ্ত করুন’ তখন সত্যিই আতঙ্ক হয়। বাংলা ভাষাটা আদৌ বাঁচবে তো? কোনায় কোনায় গজিয়ে ওঠা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাচ্চাদের সেকেন্ড ল্যাঙ্গোয়েজ আজ হিন্দি, বাংলা নয়। বাংলা শিখে তো চাকরি বাকরির সুবিধা হয় না!
অথচ এই বাংলাভাষার জন্যই আজ একুশে ফেব্রুয়ারি,বিশ্বজুড়ে কত আয়োজন! বিশ্বজুড়ে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের কথা স্বীকার করে সারা বিশ্বে আজ মানুষ নিজেদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করার শপথ নিচ্ছে। মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা তথা ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য স্পেনের বার্সেলোনার লিঙ্গুয়াপাক্স ইন্সটিটিউট তাদের বিশেষ পুরস্কার প্রদান করবে। উচ্ছ্বাস-,আবেগে ভাসছে বাংলাদেশের মানুষ। গভীর শ্রদ্ধায় তাঁরা চ স্মরণ করছেন।আব্দুস সালাম, রফিকুদ্দিন আহমেদ, আব্দুল বরকত আর আব্দুল জব্বারের বলিদানকে…যাঁরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন উর্দুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষীদের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী সংখ্যা অনেক বেশি হলেও পাকিস্তানের শাসকরা বললেন উর্দুই হবে একমাত্র সরকারি ভাষা, সেখানে বাংলার কোনও স্থান নেই। এমনকি পাকিস্তানের পাবলিক সার্ভিস কমিশনও বাংলা ভাষাকে একদম মুছে দিল। সরকারি কারেন্সি নোট, স্ট্যাম্প—সবেতেই শুধুই উর্দু। এরই প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলন। ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষায় ঢাকার রাজপথে ঝরল কত রক্ত। পিছু হটতে বাধ্য হল পশ্চিম পাকিস্তানের দোর্দন্ডপ্রতাপ শাসকেরা। ১৯৫৪ সালে সংবিধান সংশোধন করে বাংলাকে দ্বিতীয় সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হল।
এই দিনটিকেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয় রাষ্ট্রসংঘ। সেটা ১৯৯৯ সাল। তারপর থেকেই দিনটিকে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে পালন করছে ইউনেস্কো। বাংলা ভাষাকে নিয়ে ওপার বাংলার মানুষের যে আবেগ, তার কি সিকিমাত্র আছে এপার বাংলায়? এপার বাংলায় ২১ ফেব্রুয়ারি শুধু একটা আনুষ্ঠানিকতা…কিন্তু সভা, সেমিনার, কবিতা পাঠ ব্যস। কোকাকোলার মতো বহুজাতিক সংস্থাও আজ বুঝে গেছে বাংলাদেশের মানুষের মনে জায়গা করে নিতে গেলে বাংলার আশ্রয় নিতেই হবে। তাই তাদের বোতলে আজ শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন বাংলা শব্দ। কিন্তু এপার বাংলায় সেই আবেগ কোথায়? কসমোপলিটান হওয়া অবশ্যই ভালো, কিন্তু সেটা কি নিজের মাতৃভাষার বিনিময়ে? সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা ছাড়িয়ে ভাষাটাকে যখন আমরা একান্ত নিজের করে নিতে পারব সেদিনই আমাদের মনে রিন রিন করে বেজে উঠবে… ‘বাংলা ভাষা উচ্চারিত জলে নিকানো উঠোনে ঝরে রোদ/বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন…
-মতামত লেখকের নিজস্ব