হোমফিচারমাদ্রিদ হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে কর্মরত এক তরুণী চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা

মাদ্রিদ হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে কর্মরত এক তরুণী চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা

মাদ্রিদ হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে কর্মরত এক তরুণী চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা

করোনার ভয়াল সংক্রমণে স্পেনের রাজধানী এখন কার্যত মৃত্যুপুরী। মাদ্রিদ জুড়ে জারি হয়েছে কার্ফু। তবু সংক্রামিতের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। নার্সিংহোম থেকে শবদেহ নিয়ে যাওয়ার লোক নেই। কফিনবন্দি করে দেহ নিয়ে যাচ্ছেন সেনাবাহিনীর লোকেরা। শহরের একটা ইন্ডোর স্কেটিং রিঙ্কে জমা করা হচ্ছে সব দেহ। যাঁরা শেষকৃত্য করেন তাঁদের প্রয়োজনীয় কিট নেই। তাই মৃতদেহ কবর দেওয়া বন্ধ। স্তূপের মতো জমে যাচ্ছে মৃতদেহ। শহরের এই অংশটা যেন নেক্রোপলিস। হাসপাতালগুলিতে রোগীর ভিড় উপছে পড়ছে। আগের দক্ষিণপন্থী সরকার জনস্বাস্থ্যে বরাদ্দ এত বেশি ছাঁটাই করেছে যে চিকিৎসার পরিকাঠামোই ভেঙে পড়েছে। ডাক্তার ও নার্সদের হতাশা বাড়ছে। কয়েক হাজার মেডিক্যাল কর্মী সংক্রামিত।

এমন বিপন্ন শহরের এক হাসপাতালে চাকরি করেন তরুণী চিকিৎসক ইনেস লিপেরহাইড। বয়স ৩৭। পুয়ের্তা ডি হিয়েরো ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে কাজ করছেন সেই ২০০৮ সাল থেকে। হাসপাতালটা শহরের পশ্চিমে। লিপেরহাইডের অভিজ্ঞতা শুনুন তাঁর নিজের ভাষায়।

‘আমি কাজ করি হাসপাতালের ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে। সাধারণত সেখানে বেড থাকে ২২টা। এখন যতদূর সম্ভব বেডের সংখ্যা বাড়িয়ে যেতে হচ্ছে। অন্য ওয়ার্ড থেকে বেড ও ভেন্টিলেটর নিয়ে আসতে হচ্ছে। নতুন নতুন ঘরে সেইসব বেড ও ভেন্টিলেটর পেতে, অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে আইসিইউ তৈরি করা হচ্ছে। এখন ৪৫ জন কোভিড রোগী আছেন আইসিইউতে। অন্য রোগীদের জন্য আছে ১৫টি বেড। আমাদের সাহায্য করছেন অ্যানাসথেসিস্ট ও কার্ডিওলজিস্টরা।

আমাদের হাসপাতালে তবু কোনওক্রমে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছি। এরই মধ্যে সাত জন রোগীকে ছেড়ে দিয়ে বেডগুলো খালি করেছি। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে রোগীর স্রোত আমাদের ভাসিয়ে দেবে।  তখন সবকিছু চলে যাবে সাধ্যের বাইরে। যখন তেমনটা ঘটতে থাকে, তখন অন্য হাসপাতালে রোগীদের পাঠিয়েও চাপ কমে না।

যাঁরা অসুস্থ তাদের সবাইকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা আমরা দিতে পারছি না। বাছাই করতে বাধ্য হচ্ছি। ঠিক করতে হচ্ছে কাদের আইসিইউতে ভর্তি করব আর কাদের ফিরিয়ে দেব। দেখতে হচ্ছে কাদের চিকিৎসা করলে বাঁচাতে পারব, কাদের পারব না। বয়স্ক লোকেদের মাল্টিপল অরগ্যান ফেলিওর হলে তাঁদের বাঁচার সুযোগ খুবই কম। ফলে তাঁদের বাদ দিতে হচ্ছে। এভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই তীব্র যন্ত্রনার।  এখন দিনের বেলায়বেশি রোগী আসছেন। দৃশ্যটা একটা ভয়ের ছবি বা হরর ফিল্মের মতো। মাদ্রিদে ২০০৪ সালে সন্ত্রাসবাদী হানার ঘটনা ঘটেছিল। সেদিনও আমি ডিউটিতে ছিলাম। সেটাও ছিল ভয়ঙ্কর একটা দিন। তবে দুএকদিন পরে অবস্থার উন্নতি হয়েছিল। এখন জিনিসটা পুরোপুরি আলাদা। এখানে রোজই পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।

ভয় পেয়ে যাচ্ছেন রোগীরাও। ৬৫ বছরের এক রোগী আমাকে প্রায় আঁকড়ে ধরেছিলেন। তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ। পরিবারের কাউকে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। সাধারণ অবস্থায় তাঁকে অনেকদিন আইসিইউতে রাখা যেত। কিন্তু তিনি আমাদের কাছে প্রায় ভিক্ষা করার মতো আর্জি জানাতে থাকেন তাঁকে যেন অন্যত্র সরানো হয়। কারণ সেখানে তিনি আরো রোগীর সঙ্গ পাবেন। তাঁর দেখাশোনাও হবে ভাল করে। কিন্তু আমরা তাঁকে সরাতে পারিনি। তবে এখন তাঁর অবস্থা কিছুটা ভাল। তবু এক একটা মুহুর্ত আসে যখন নিজেক অসহায় মনে হয়। আমাদের আপৎকালীন পরিষেবা চলছে সাত দিন, চব্বিশ ঘণ্টা। সবাই স্বেচ্ছায় বেশি সময় কাজ করছেন। আমি নিজেও ঠিক বলতে পারব না সপ্তাহে কত ঘণ্টা কাজ করছি। বোধ হয়, ৮০ ঘণ্টার বেশি। সহকর্মীদের সম্পর্কে বলতে পারি, এই সংকটে তাঁরা তাঁদের সেরাটা দিচ্ছেন। এখনও কারোর সঙ্গে আমার কোনও বিতর্ক বাধেনি। সবাই এখন একজোট হয়ে লড়ে যাচ্ছেন কারণ তাঁরা জানেন পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর। মাস্ক, প্রোটেকটিভ গ্লাস, গ্লাভস ফুরিয়ে গেছে। বলা যায়, কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। একবার পরা মাস্ক ধুয়ে নিয়ে দুবার পরতে হচ্ছে। ওপরের জামা দিনে একবার বদল করতে পারছি। কেউ কেউ চোখ ঢাকতে ডাইভিং গগলস ব্যবহার করছেন। এটা খুবই সম্ভব যে আমরাও সংক্রামিত হয়ে যেতে পারি। সকলেই সেটা জানেও। স্পেনে যে ৩৩ হাজার লোকের করোনা পজিটিভ এসেছে তাদের এক তৃতীয়াংশ কাজ করে মেডিক্যাল সেক্টরে। এবার শুধু ভেন্টিলেটর আর বেডই কম পড়বে না, কাজ করার লোকও পাওয়া যাবে না।

রোজ বাড়ি ফিরে আমি কাঁদি। যখন টিভিতে দেখি কত লোক মারা গেছেন তখন আমার কান্না পায়। এক একাই কাঁদি। সেই কান্না থামতে চায় না। আমি একাই থাকি। গত দু সপ্তাহ বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা হযনি। দেখা হয়নি পরিবারের কারোর সঙ্গে। ভয় করে যে, কাছে গেলে হয়ত আমিই ওদের সংক্রমণের কারণ হয়ে যাব। এটা দারুন কষ্টের ব্যাপার। আমার এখন কী দরকার জানেন? কেউ যেন আমাকে আদর করে জড়িেয় ধরে, আমি যেন আমার মনের সব ভার তার ওপর ছেড়ে দিতে পারি। চাই একটু কোমলতা, চাই একটু স্নেহ। যে পরিস্থিতিতে দিন কাটছে তা খুবই দুঃসহ।  রোজ রাত ৮টায় ফ্ল্যাটের জানলাটা খুলি। শুনতে পাই সব ফ্ল্যাটের জানলা বা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ডাক্তার আর নার্সদের সম্মান জানাচ্ছেন মানুষ। এটাই মনকে স্পর্শ করে যায়। লোকেরা বুঝতে পারছে যে আমরা আমাদের সমস্ত শক্তি উজাড় করে দিচ্ছি। এটুকুই আমরা পারি।

সূত্র — জার্মান পত্রিকা ডার স্পিগেল। সাংবাদিক স্টিফেন লুডকের প্রতিবেদন। ভাষান্তর : সুচিক্কণ দাস।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img