হোমফিচার'রাজনীতি করবেন না'-র রাজনীতি

‘রাজনীতি করবেন না’-র রাজনীতি

‘রাজনীতি করবেন না’-র রাজনীতি

শেখ সাহেবুল হক

রাজনীতিতে ‘সফট টার্গেট’ একটি খুবই কার্যকর জিনিস৷ এতে দোষারোপ করে দায় এড়ানো যায়। লক্ষ্য রাখতে হবে এমন একটি সফট টার্গেট বাছতে হবে যাতে অধিকাংশ মানুষের মনে ধরে, ‘হ্যাঁ এরাই দোষী।’

সাম্প্রতিক অতীতে রাহুল গান্ধীর মতো তৃতীয় শ্রেণির নেতা যখন করোনা নিয়ে সাবধান করছেন, তখন টুইটারে তাঁর খিল্লি হয়েছে। ‘করোনায় আক্রান্ত ইতালির প্রসঙ্গ টেনে, মামাবাড়ির জন্য খুব চিন্তা’ ইত্যাদি বলা হয়েছে। ঘোড়া কেনাবেচা এবং সরকার গড়ার চেষ্টার মধ্যে যাঁরা ভাবেননি করোনা নিয়ে সামগ্রিক প্রতিরোধের কথা৷ বরং তখনও গোবর-গোমূত্রে করোনা সারানোর তত্ত্ব মার্কেটে বিকোচ্ছে। শয়ে শয়ে প্রবাসী ভারতীয়রা দেশে প্রবেশ করছেন৷ এরপর করোনা ধরা পড়ার খবর প্রকাশ্যে আসতে লাগলো। সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু হবে এমন পরিস্থিতিতে ‘রাজনীতি করবেন না’ ন্যারেটিভ ছড়িয়ে দেওয়া হলো। পরিস্থিতি যত জটিল হতে লাগল, ততই তীব্র হতে লাগল, ‘রাজনীতি করবেন না।’ এই ‘রাজনীতি করবেন না’ ব্যাপারটিই আসলে সবচেয়ে চতুর রাজনীতি।

‘এই যে দাদা স্যানিটাইজার নেই, মাস্ক নেই!’
-এইসময় রাজনীতি করবেন না!

‘আচ্ছা পরিকাঠামোর অভাব কেন?’
-রাজনীতি করতে লজ্জা করছে না?

‘বিশাল মূর্তি না বানিয়ে যদি হাসপাতাল করা যেত!’
-আপনাদের সবেতেই রাজনীতি।

‘মানুষ ২১ দিনের লকডাউনে খাবে কী?’
-আপনি দায়িত্ব নিন। এত দরদ আপনাদের। প্রধানমন্ত্রী বাড়ি বয়ে খাবার দিয়ে যাবেন? নোংরা রাজনীতিতেই দেশটা শেষ হয়ে যাবে।

‘পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরতে পারছেন না, খাবার পাচ্ছেন না। ওভাবে জমায়েত করলে তো রোগ ছড়াবে। সরকারের দায়িত্ব নেই?’
-লকডাউন দেশের সবার কথা ভেবে হয়েছে৷ যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। শ্রমিকদের কে ফিরতে বলছে, যেখানে আছে সেখানেই থাক। সরকার খাবার পাঠাবে বলেছে। আপনাদের সবেতেই সরকার বিরোধিতা।

‘প্রবাসী ভারতীয়দের যথাসময়ে সঠিক পরীক্ষা এবং উড়ানে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে কি ভালো হতো না? কনিকা কাপুরের মতো কতজন শুধু পয়সাওয়ালা হওয়ার কারণে ফাঁকতালে বেরিয়ে গেছেন!’
-প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বেশি জানেন? এজন্যই সিপিএম ৭% ভোট পেয়েছে।

লক্ষ্য করুন, আগাগোড়া যাঁরা বলে এসেছেন, ‘রাজনীতি করবেন না।’ তারাই এখন নিজামুদ্দিন মার্কাসের ধর্মীয় সভায় কয়েকজনের করোনা ধরা পড়ায় হিন্দু-মুসলমানের রাজনীতিতে নেমেছেন৷ কারণ তাঁরা সফট টার্গেট পেয়ে গেছেন। এখন রাজনীতি করা যেতেই পারে। ইস্যুটা হিন্দু-মুসলমানে নিয়ে যেতে পারলে লোক জানতে চাইবে না মেডিক্যাল কিট নেই কেন, কেন মানুষের হাতে খাবার নেই ইত্যাদি। সর্বোপরি ঘৃণার রাজনীতিটাও চলতে থাকবে৷

হিন্দু-মুসলিম রাজনীতি না করে কয়েকটি প্রশ্ন তোলা যাক।

১.নিজামুদ্দিন মার্কাসের ঘটনা চিন্তাজনক। ওখানকার লোকজন যা করেছেন তা আইনত অপরাধ। কিন্তু এটা খতিয়ে দেখতে হবে তাঁরা কি পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন? পুলিশ কি তাঁদের সাহায্য করেছিল?

২.নিজামুদ্দিন মার্কাসে লোক আছে, এই খবর সরকারের অজানা থাকার কথা নয়। সরকার কি ব্যবস্থা নিয়েছিল ওইসকল মানুষদের বের করে সংক্রমণ চিহ্নিত করে পৃথকভাবে গৃহবন্দী রাখতে?

৩.’সব শালা মোল্লাদের দোষ’ বললে হয়তো দায় এড়িয়ে যাওয়া যায়৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা সরকার তো সংখ্যালঘুদেরও। সরকারের দায়িত্ব ছিল, আরও তৎপর হওয়া।

৪.জনতা কার্ফুর দিন হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বেরিয়েছেন থালাবাসন বাজাতে, কেউ কেউ নাচানাচি করেছেন। সেখান থেকে সংক্রমণ ছড়ালে কি বলা হবে জৈনরা ছড়িয়েছেন বা খ্রিষ্টানরা৷ কোনও হিন্দুভাই কি বলতেন ‘আমাদের জন্যই ছড়িয়েছে। কারণ তাহলে চিনের মানুষদের বা ইতালির মানুষদের ধর্মপরিচয় তুলে আক্রমণ হত। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সেটা হয়েছে কি? ভারতে হচ্ছে, কারণ সফট টার্গেট বেছে ধর্মীয় রাজনীতি করে মূল সমস্যা এবং ব্যর্থতা আড়াল করা হবে।

৫.কেন্দ্রীয় সরকারের অব্যবস্থার ফলে দিল্লিতে শ্রমিকদের বিপুল জমায়েতে করোনা ছড়ানোর ব্যাপক সম্ভাবনা নিয়ে সেভাবে প্রশ্ন তোলা হয়েছে কি? তখনও কেউ কেউ বলেছেন ‘প্রধানমন্ত্রী চেষ্টা করছেন। সময় দেওয়া উচিত।’ কিন্তু যখনই মুসলিমদের দোষ দেওয়ার সুযোগ এসেছে তাঁরাই বেরিয়ে পড়েছেন দাঁত-নখ বের করে।

৬.অনেকেই বলছেন ‘অশিক্ষিত মোল্লা সব। শালাদের গুলি করে মারা উচিত।’ এটা জাস্ট বিদ্বেষ থেকে বলছেন তাঁরা। ভারতে রোগ ছড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ এন.আর.আইদের অসাবধানতা এবং সঠিক নির্দেশ না মানা। নবান্নের আমলাপুত্র কি শিক্ষিত ছিলেন না? সরকারি নির্দেশ ফলো না করা প্রবাসী ভারতীয়দের ডিগ্রি তো ‘অশিক্ষিত মোল্লা’দের চেয়ে বহুগুণে বেশি।

পুনশ্চঃ তাহলে বোঝা যাচ্ছে, ‘রাজনীতি করবেন না’ বলা লোকেরা প্রথমে এই ন্যারেটিভ নামাতেন সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা ভ্যালিড প্রশ্নকে থামাতে৷ এরপর সঠিক সময়ে তাঁরা ধর্মীয় রাজনীতিতে নেমে পড়েছেন। কেউ কেউ ‘ভাইরাস জিহাদ’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার করছেন। এঁদের কে বোঝাবে কেউ অপরাধ করলে তার তদন্ত হবে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি সরকার কি সত্যিই তৎপর ছিল, সেই প্রশ্ন তুলতে হবে। নিজামুদ্দিন মার্কাসের কর্তৃপক্ষ সত্যিই দোষী হলে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে৷

এই সময়ই রাজনীতি করার সময়, সরকারি দায়বদ্ধতা এবং উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময়৷ স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ না করে স্ট্যাচু বানানো নিয়েও প্রশ্ন তুলতে হবে। রাজনীতি হোক, তবে হিন্দু-মুসলমানের নয়৷ কারণ করোনা হিন্দু-মুসলমান তফাত করে না। এরপরও যদি মনে হয় ধর্ম-জাত ইত্যাদি খোঁজার প্রয়োজন আছে, তবে আপনি বিদ্বেষ ভাইরাসে আক্রান্ত। পৃথিবীর থেকে করোনা একদিন নির্মূল হয়ে যাবে, কিন্তু এই বিদ্বেষ আপনার উত্তর প্রজন্ম উত্তরাধিকার সূত্রে পাবে, যার কোনও অন্ত নেই।

ফেসবুক থেকে নেওয়া।
মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img