হোমফিচারলকডাউনে বেড়েছে 'ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স', সফট টার্গেট মেয়েরাই

লকডাউনে বেড়েছে ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স’, সফট টার্গেট মেয়েরাই

লকডাউনে বেড়েছে ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স’, সফট টার্গেট মেয়েরাই

বর্ণালী জানা বর্ণালী জানা

শেষমেষ ঝুলি থেকে বেড়ালটা বেরিয়েই গেল। বিবৃতি দিলেন খোদ রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। লক-ডাউনের দিনগুলোতে মেয়েদের ওপর বাড়ছে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স। হ্যাঁ, পৃথিবী জুড়েই। ব্রিটেনের ‘দ্য ন্যাশনাল ডোমেস্টিক অ্যাবিউজ’ নামে একটি সংস্থা জানিয়েছে, সম্প্রতি তাদের হেল্পলাইনে সাহায্য চাওয়ার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আরও একটা রিপোর্টে দেখা গেছে লক-ডাউন চলাকালীন ফ্রান্সে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বেড়েছে ৩০ শতাংশ। আর ভারত? যেখানে পণ না আনার কারণে বা শিশুকন্যা জন্ম দেওয়ার অপরাধে মেয়েদের পোড়ানো হয়…গলা টিপে খুন করা হয় ,সেখানকার অবস্থা আর না বলাই ভালো ! করোনা এসে এমনিতেই ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকা মেয়েগুলোকে আরও ভালনারেবল করে দিয়ে গেল। দেদার বাড়ল বউ পেটানো। গত ২৩ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত শুধু ইমেল মারফৎ পারিবারিক হিংসার ৫৮ টি অভিযোগ জমা পড়েছে জাতীয় মহিলা কমিশনের কাছে। নোভেল করোনা ভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে ২৪ মার্চ মধ্যরাত থেকে জারি হয়েছে একুশ দিনব্যাপী লকডাউন। এমন পরিস্থিতিতে মহিলাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন বেড়ে গেছে বলে জাতীয় মহিলা কমিশন সূত্রে খবর। উত্তরভারত, বিশেষ করে পাঞ্জাব থেকেই নাকি সবচেয়ে বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। লক-ডাউনের জেরে কেউ বাড়ি থেকে বেরোতে পারছে না, না হলে ডাকযোগে আরও অভিযোগ জমা পড়ত বলে দাবি করেছেন জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা। মোদ্দা কথা মেয়েদের কাছে এ একটা বড় সুখের সময় নয়।

অনেকে অবশ্য আহারে, বাছারে করছেন। ছেলেগুলো ঘর থেকে বেরোতে পারছে না। সারাদিন ঘরে বসে হতাশা আসছে…ডিপ্রেশন হচ্ছে…তারাই বা কী করবে? তাই যাবতীয় হতাশা ঝেড়ে দিতে হবে বাড়ির মহিলাটির ওপর। এমন সফট টার্গেট মিলবে কোথায়? এই রোগের কোনও দাওয়াই নেই। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বাড়ানোই এর প্রতিকারের একমাত্র উপায়। সিনেমা নেই, শপিং নেই, ডাইনআউট নেই… তার ওপর অ্যালকোহলও নেই! কী করে কাটবে সময়? ‘ এই যে অ্যালকোহল পাওয়া যাচ্ছে না। তাতে এক শ্রেণির পুরুষ আরও হিংসাত্মক হয়ে পড়ছেন…তাদের মনের বিকার বাড়ছে। বাড়ির মহিলাদের ওপর হাত তুলছেন’…পেশেন্টদের কাছ থেকে এমন অনেক অভিযোগ পেয়েছেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট গার্গী দাশগুপ্ত। অল ইন্ডিয়া প্রোগ্রেসিভ উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন-এর এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে যে মহিলারা যোগাযোগ করেছেন তাঁরা বলেছেন লক-ডাউন ঘোষণা হবে জানলে তাঁরা আগেই বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতেন, হয়তো বাপের বাড়ি, হয়তো অন্য কোথাও। ‘ব্যাপারটা হল স্পেস..সেটা ছেলেদেরও যেমন প্রয়োজন মেয়েদেরও…যারা বাইরে কাজ করেন বা যারা গৃহবধূ প্রত্যেকেরই। ছেলেরা কাজে যেতে পারছেন না…অন্য জগতে সময় কাটাতে পারছেন না ,তাই তাঁদের ডিপ্রেশন আসছে, আর মেয়েদের আসছে না…এটা একেবারে বাজে কথা’…এমনই মত গার্গীদেবীর। কিন্ত সমস্যাটা হল মেয়েদের হতাশাটা দেখানোর জায়গা নেই…কারণ তাদের হতে হবে সর্বংসহা । যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদের হতাশা কাটাতে তাদের কমফর্ট গার্ল হতে হবে, তাদের ওয়াকাই-তে যেতে হবে, তথাকথিত আইএস ধর্মোযোদ্ধাদের যৌনদাসী হতে হবে…সব ছেলেদের হতাশা কাটানোর জন্য। দেশে ধর্ষণ বাড়বে…নারী নিগ্রহ বাড়বে…আর সমাজ বিশেষজ্ঞরা কলাম লিখবেন…আসলে দেশে এত বেকারত্ব, এত হতাশা…! ‘আর যে মেয়েটা বাড়ির চার-দেওয়ালের বাইরে প্রতিদিন অফিসে নিজের কাজের জায়গায় একটা আনন্দ খুঁজে পেত সে তাহলে ঘরবন্দি হয়ে কী করবে? তার হতাশা আসবে না, অস্থিরতা আসবে না? নাকি ওগুলোতে শুধু ছেলেদেরই একচেটিয়া অধিকার?’-প্রশ্ন তুললেন মনোবিদ সপ্তদীপা সাহা। আবার মনোবিদ পম্পা মৈত্র চক্রবর্তীর একটু অন্য রকম কথা বললেন। তাঁর মতে, এই লক-ডাউনের সময় পশ্চিমের দেশগুলিতেই ডোমেস্টিক অ্যাবিউজ বেশি হচ্ছে । এখানে তাও বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা থাকেন, কিছু আত্মীয়-স্বজন থাকেন ,তাদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু বাইরের দেশগুলোতে শুধু স্বামী-স্ত্রী…আর বাচ্চা…তাই তাদের একঘেঁয়েমি চলে আসছে খুব সহজেই।
পম্পাদেবীর মতে, এই লক-ডাউনের সময় কিন্তু অনেক ভালো কিছুও হতে পারে। নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করতে পারি আমরা। সারা দিনের ব্যস্ততার ফলে স্বামী হয়তো আগে জানতেই পারতেন না, বউ এত ভালো কবিতা লিখতে পারে, আর স্ত্রীও হয়তো কোনওদিন জানতে পারেননি,তাঁর পাশের মানুষটা এমন গুছিয়ে চিকেন কারি রাঁধতে পারেন। নিজেদের নতুন করে খুঁজে পাওয়ার আনন্দটা কি সাত রাজার ধন এক মানিক পাওয়ার চেয়ে কিছু কম?
ঝুম্পা লাহিড়ীর গল্পটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে না? তখন লক-ডাউন নয় ব্ল্যাক-আউট। বিদ্যুতের লাইন সারানোর জন্য সন্ধের সময় কয়েক ঘণ্টা করে শহর অন্ধকার, নিষ্প্রদীপ। সেই কয়েকদিনের অন্ধকারে মোমবাতির আলোর সামনে বসে দুজন সঙ্গী নিজেদের আবার নতুন করে খুঁজে পেয়েছিল। দীর্ঘ দিনের না বলা কথা, জমা অভিমান…সব তারা দূরে সরিয়ে ফেলতে পেরেছিল, যা দাম্পত্যের এতগুলো বছরেও পারেনি। পৃথিবীর এই গভীর অসুখের সময় হতাশা ফেলে, ঝগড়া-ঝাঁটি ফেলে… আলোর দিকে আমরা এমনভাবে কি যেতে পারি না?

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img