হোমফিচারশিল্পী দল ও শিল্প ভাবনা

শিল্পী দল ও শিল্প ভাবনা

শিল্পী দল ও শিল্প ভাবনা

মহুয়া ভট্টাচার্য। সাংবাদিক ও চিত্রশিল্পী

বিভিন্ন শিল্পীদলকে নিয়ে “শিল্পী ও শিল্প ভাবনা” নামে একটি ধারাবাহিক আমরা প্রকাশ করছি। প্রথম শিল্পী দলটি ছিল “দ্য গ্রুপ “। এবারের শিল্পী দল “পেন্টার্স অর্কেস্ট্রা“।

নামটা খুবই সঙ্গীতময়। পেন্টার্স অর্কেস্ট্রা। না, এটা কোনও সঙ্গীতের প্রতিষ্ঠান নয়। চিত্রকলা ও ভাস্কর শিল্পীদের প্রতিষ্ঠান। নামটা সবারই পছন্দের। এই নামকরণে রামকিঙ্কর বেইজ খুবই খুশি। ১৯৭৫ সালে দলের নামকরণ হয় পেন্টার্স অর্কেস্ট্রা। নামকরণ করেছিলেন পেন্টার ধর্ম নারায়ণ দাশগুপ্ত। প্রথম থেকেই নামকরণ নিয়ে একটা বিভ্রান্তি ছিল। ১৯৬০ সাল থেকেই কলকাতায় চিত্রশিল্পীদের দল গঠন নিয়ে এক আবহ সৃষ্টি হতে শুরু করেছিল। বিরাট মাপের শিল্পী হলেই চলবে না। শিল্পের একটা ধারাবাহিককতা দরকার, বাজার তৈরি করতে হবে, বিভিন্ন মহলে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে হবে। এ দায়িত্ব শিল্পীদের নিজেদেরই নিতে হবে। তাই দল গঠনের একটা হিড়িক পড়ে গেল। কলাভবনের প্রাক্তন ছাত্ররা মিলে তৈরি করলেন একটি দল। নাম দেওয়া হল কলাভবনের প্রাক্তন ছাত্রদের দল। নামটা কারও পছন্দ নয়। সমালোচনার মুখে পড়তে হল। শিল্প করতে এসে শিল্প ও শিল্পীর ভূমিকা বড়, না কলাভবনের প্রাক্তন ছাত্রদের ভূমিকা বড়! শিল্পী হয়ে সীমানা নির্ধারণ! এটা খুবই নিম্নমানের অভিরুচি। শিল্পীদের কোনও জাত থাকে না, ধর্ম থাকে না। শিল্পের ভাষা আন্তর্জাতিক, মানবিক , গোষ্ঠীবদ্ধ নয়। তা ছাড়া অনেকেই তখন সদস্য হবার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। অতএব নাম বদলে রাখা হল পেন্টার্স অর্কেস্ট্রা। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, উদ্যোগটা এসেছিল কলাভবনের ছাত্রদের মধ্যেই। বরোদায় পাঠ শেষ হওয়ার পর পার্থপ্রতিম দেব কলকাতায় এলেন। চিন্ময় রায় তখন কলাভবনে পোস্ট ডিপ্লোমা করছিলেন। জহর চাদ দেশানী একটি বৃত্তি নিয়ে রাজপুত চিত্রকলার উপর কাজ করছিলেন। বিপুল কান্তি সাহা বরোদায় ভাস্কর্যে পোস্ট ডিপ্লোমা করছিলেন।

শুচিব্রত দেব, জহর দাশগুপ্ত, রামচন্দ্র প্রধান, অতুল বড়ুয়া, কে এস বিশ্বম্ভর, ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত সবাই এই দলভুক্ত হলেন। সবাই একই ঘরানার। ১৯৬৮ সালে সবাই মিলে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে প্রথম প্রদশর্নীর আয়োজন করলেন। এই প্রদশর্নীতে উপস্থিত ছিলেন অমিত রায়, জহর চাদ দেশানী, শান্তনু ভট্টাচার্য, বিপুল কান্তি সাহা। পরবর্তী সময়ে অন্যান্যরা যোগ দিয়েছিলেন। সবাই প্রতিষ্ঠিত, ঘরানা এক অথচ বৈচিত্র্যপূর্ণ। তবু সমালোচকদের কড়া নজরদারি উপেক্ষা করা গেল না।

মহিম রুদ্র একটি ইংরেজি কাগজে সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, প্রদশর্নীর মান এত খারাপ যে দোষটা শিল্পীদের, না যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা পেয়েছেন সেখানকার। পরবর্তীকালে শিল্পীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে প্রমাণ করেছিলেন যে, সমালোচকের অতি সক্রিয়তাই এই ভাবনার জন্ম দিয়েছিল।

শিল্পী পার্থ প্রতিম দেব কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলা বিভাগের ডিন হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর শৈলী শুধু ছাত্রদের মধ্যেই সমাদৃত নয়, বিদগ্ধ সমাজেও সমানভাবে আদৃত। তাঁর অনুপ্রেরণা সমস্ত শিল্প শিক্ষার্থীর কাছে আদর্শ। তাঁর নিজস্বতা, তাঁর ড্রয়িং-এর করণ কৌশল, ইন্টেলেকচুয়াল এক্সপ্রেশন যা রসিক সমাজকে মুহূর্তে অন্য রসায়নে নিয়ে যেতে পারে। সেই সুযোগে সমাজের অন্যায়ের প্রতি কটাক্ষ করতেও পিছুপা হন না। তাঁর শিল্পকর্ম তাঁকে সকলের চেয়ে ব্যাতিক্রমী করে তুলেছে।

শুচিব্রত দেব কলাভবনের ছাত্র। তিনি জীবনে দুই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীকে পেয়েছিলেন। তাঁরা হলেন রামকিঙ্কর বেইজ ও বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়। এ ছাড়া নন্দলাল বসুর শিল্পধারাতেও অনুপ্রাণিত এই শিল্পী। রবীন্দ্রনাথ চাইতেন শিল্পীরা দেশীয় শিল্প ধারার সঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষায়ও শিক্ষিত হয়ে উঠুক। এর ফলে যে উন্নতমানের শিল্পশৈলী তৈরি হবে, তাতে শিল্প ধারা এক অন্যমাত্রায় উন্নীত হতে পারবে। শুচিব্রতর শিল্পশৈলী সেই ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। তিনি দুই ধারাকেই তাঁর কাজে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন।চিন্ময় রায় কলাভবনের শিল্পী। দীর্ঘ কাল ধরে কাজ করে চলেছেন। প্রচার বিমুখ ব্যক্তিত্ব। নিজস্ব শৈলীর যথার্থতায় চিত্রভাষা সম্পৃক্ত করেন।

জহর দাশগুপ্তর শিল্পশিক্ষণের পাঠ কলাভবন থেকে। তিনি একজন ভালো সংগঠক। প্রচন্ড হাসিখুশি মানুষ। শান্তনু ভট্টাচার্য কলাভবনের ছাত্র। মূক ও বধির শিল্পী। তাঁর ছবিতে দেশজ ঐতিহ্যের বিস্তার। শান্তনু অবনীন্দ্রনাথের মন্ত্রেই দীক্ষিত। অবনীন্দ্রনাথ মনে করতেন ” নিজের দেশের এত সম্পদ থাকতে পরের দেশের জিনিস চুরি করব কেন? ”

তাপস শঙ্কর বসুর কাজেও যথেষ্ট নিজস্বতা রয়েছে। তিনি অনেকরকম পরীক্ষামূলক কাজ করেছেন। পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পী বিরাজ কুমার পাল। ভালো সংগঠক। কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাস্তবরীতির ছবিতে তাঁর দক্ষতা। প্রতিকৃতি অঙ্কনে তিনি এক নতুন মাত্রার সংযোজন করেছেন। বিরাজের ছবিতে স্নিগ্ধতা দেখবার মত।

অরুণ কুমার মজুমদার ইনস্টলেশনধর্মী কাজ করেন। এই শিল্পীর কাজে অন্য একটা মজা আছে। মানসী মিত্র আধা বিমূর্ত কাজ করেন। বর্ণের সমাহারের পাশাপাশি রেখার জ্যামিতিক বিভাজন তাঁর কম্পোজিশনকে বিশিষ্টতা দেয়।দিব্যেন্দু বসুর শিল্প শিক্ষণের পাঠ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিষয় সন্ধানে তিনি সবসময় ব্যতিক্রম। ডক্টর বিবেকানন্দ মুখার্জি উত্তর আধুনিক শিল্পভাবনায় প্রতিষ্ঠিত। বড় মাপের কাজও যেমন করেন, ছোটো মাপের কাজও সমানভাবে করেছেন। শিল্পীর কাজের সার্বিক রূপ, জমি বিভাজন দক্ষতায়, অনবদ্যতা লক্ষণীয়। স্বপন কুমার সাহা রবীন্দ্রভারতীর ছাত্র। গ্লাস পেন্টিং করেন। এই ব্যাপারে তাঁর স্বকীয়তা প্রশংসনীয়। শ্যামল মুখার্জি রবীন্দ্রভারতীর ছাত্র। তিনি ব্যঙ্গাত্মক অভিব্যক্তিতে সমাজ দর্শনের ছবি তুলে ধরেন। এই বাবুবিবিরাই শ্যামলের ছবির সদস্য। সুব্রত বিশ্বাস রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। শিশির টিকাদার রবীন্দ্রভারতীর ছাত্র। তিনি ভাস্করশিল্পী। বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যে তাঁর শিল্পকর্ম আকর্ষণীয়।

২০১৮ সালে এই শিল্পী দলের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠিত হল। এই দলের সদস্য সংখ্যা ১৪ । যৌথ ভাবে আজও তাঁরা কাজ করে চলেছেন স্বমহিমায়, নিজস্ব বিশ্বাসে ভরপুর হয়ে। নামের যথার্থতা ও মর্যাদা তাঁরা বয়ে নিয়ে চলেছেন। আগামী দিনেও এই বহতা বজায় থাকবে বলে সবার বিশ্বাস। কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ্ ফাইন আর্টসে, বিড়লা অ্যাকাডেমি অফ আর্ট অ্যান্ড কালচারে, কেমব্রিজ গ্যালারিতে এবং প্রসেসনিয়মস্ আর্ট সেন্টারে ১৯৬৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত অনেক প্রদশর্নী সংগঠিত করেছে এই শিল্পী দল।

১৯৭৫ সালে মুম্বাইয়ের জাহাঙ্গির আর্ট গ্যালারিতে এবং ২০০৪ সালে নেহেরু সেন্টারে এই দলের প্রদর্শনী হয়েছে। দিল্লির আইফোনে ১৯৭৬ এবং ২০০৬ সালে লোকায়ত আর্ট গ্যালারিতে প্রদশর্নী করেছে এই দল। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ নন্দন গ্যালারিতে ১৯৬৯ সালে প্রদশর্নী করেছে এই দল। শিল্পী দলের অংশগ্রহণের তালিকায় আছে অবনী সিগনেচার আর্ট ফেস্ট ২০০৮ সালে। ললিত কলা আ্যকাডেমির কলা মেলায় দিল্লিতে, ব্যাঙ্গালোর এবং কলকাতায় অংশগ্রহণ এই দলের। পেন্টার্স অর্কেস্ট্রা শিল্পী দল থেকে প্রকাশিত হয়েছে সেরিগ্রাফের অ্যালবাম, রঙিন পোস্টকার্ড ( দলীয় শিল্পীদের কাজের প্রতিলিপি নিয়ে) বিশিষ্ট কবিদের কবিতা অবলম্বন করে দলীয় শিল্পীদের আঁকার ছবির প্রতিলিপি সমৃদ্ধ প্রকাশনা। ১৯৯৪তে প্রকাশিত হয়েছে এই শিল্পী দলের ২৫ বর্ষের সমৃদ্ধ পুস্তিকা। শিল্পীদের ড্রয়িং সমৃদ্ধ ফটোকপি, ড্রয়িং-এর হলেও এবং গ্রাফিক্স অ্যালবাম প্রকাশিত করেছে এই শিল্পী দল। বিভিন্ন শিল্প কর্মশালা যেমন টেরাকোটার কর্মশালা, ছাপচিত্রের কর্মশালা, এবং বাগোয়ান ফাউন্ডেশনের কর্মশালায় দলীয় শিল্পীরা কাজ করেছেন। ২১শে সেপ্টেম্বর ২০১৮ তে দলীয় শিল্পীদের ড্রয়িং সমৃদ্ধতায় প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার আকৃতি আর্ট গ্যালারিতে।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img