সঞ্জয় বসাক, জগন্নাথ ভক্ত
রঘু দাসের শ্রীজগন্নাথ দর্শন
একসময় পুরীধামে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের একজন মহান ভক্ত ছিল। সে শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের সিংহদ্বারের কাছে একটি বড় ছাতার নীচে থাকত। একবার সে যখন জগন্নাথ দর্শন করতে গেল, তখন সে বিগ্রহবেদীতে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতাদেবীর দর্শন পেল। সেইদিন থেকে তাঁর দৃঢ়বিশ্বাস হল যে, শ্রীজগন্নাথ শ্রীরামচন্দ্র থেকে অভিন্ন। শ্রীজগন্নাথের প্রতি রঘুর সখ্য প্রীতি জন্মালো।
একবার রঘু শ্রীজগন্নাথের জন্য একটি সুন্দর মালা গেঁথে জগন্নাথকে দেয়ার জন্য সে পূজারীকে দিল। কিন্তু পূজারী সেটি ভগবানকে দিতে চাইলেন না, কেননা কলার বাকল থেকে সূতো তৈরি করে রঘু মালাটি গেঁথেছিল। সেই সময়ে জগন্নাথ মন্দিরে এইসব দ্রব্য নিষিদ্ধ ছিল। তাঁর মালাটি জগন্নাথকে দেয়া হল না দেখে রঘু অত্যন্ত দুঃখিত, বিমর্ষ হয়ে মন্দির ত্যাগ করল।
সেইদিন সন্ধ্যায় পূজারী সন্ধ্যারতি সমাপন করলেন। ভগবান শয়নে যাওয়ার পূর্বে পূজারীরা তাঁকে একটি বিশেষ বেশ পরান, যাকে বলা হয় বড়-শৃঙ্গার বেশ। সেদিন এইভাবে বেশ কয়েকবার পূজারী ভগবানের শ্রীঅঙ্গ ফুল দিয়ে সাজাতে শুরু করলেন। কিন্তু বিস্ময়ের সাথে তিনি লক্ষ্য করলেন যে, ভগবানের দেহে একটি ফুলও থাকছে না। ভগবান কোনও ফুলই গ্রহণ করছেন না। সমস্ত পূজারীরা এই ভেবে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন যে, তাঁরা নিশ্চয়ই কোন গর্হিত অপরাধ করেছেন।
কিন্তু কি সেই অপরাধ? তাঁরা স্থির করলেন যে, কী অপরাধ করেছেন, তা জানবার জন্য তাঁরা সবাই মন্দিরেই শয়ন করবেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না ভগবান তাঁদেরকে তাঁদের অপরাধ সম্বন্ধে বলছেন, তাঁরা উপবাসী থাকবেন।
সেইদিন রাত্রেই জগন্নাথ প্রধান পূজারীর নিকট স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে বললেন, “আমার ভক্ত রঘু দাস আমার জন্য একটি ফুলের মালা এনেছিল। সে কত ভক্তি ও প্রীতি সহকারে সেটি গেঁথেছিল! তুমি কেবল বাইরে থেকে সূতোটি দেখে তাঁকে ফিরিয়েছ – আমাকে মালা অর্পণ করার অনুমোদন দেওনি। এখন আমার সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে আমার ভক্ত তাঁর বাড়িতে মালাটি সামনে রেখে বিষণ্ণ মনে শয়ন করে আছে। সে কিছুই আহার করেনি। আর অবিরাম অশ্রুপাত করছে। এখনও সে নিদ্রা যায়নি। আমার ভক্তের ইচ্ছাপূরণ না হলে আমি কিভাবে তোমাদের কাছ থেকে মালা গ্রহণ করে নিদ্রা যাব?”
তৎক্ষণাৎ পূজারী জেগে উঠে অন্যান্য পূজারীদেরকে সব কথা জানালেন। তখন তাঁরা সকলে রঘুদাসের কাছে গিয়ে অপরাধ স্বীকার করলেন এবং শ্রীজগন্নাথদেবকে তাঁর মালা অর্পণ করতে বললেন। রঘু দাস অত্যন্ত খুশি হল এই শুনে যে, ভগবান এতই করুণাময় যে, তিনি স্বয়ং তাঁর মালা গ্রহণের জন্য অপেক্ষা করছেন। রঘুদাস আনন্দে বিহ্বল হল।
ভক্ত সেবায় শ্রীজগন্নাথদেব
ভক্ত রঘু দাস একসময় গুরুতর অসুখে পড়ল। তাঁর স্বাস্থ্য এতই ভেঙে গেল যে, তাঁর আর বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াবার শক্তি রইলো না। শয্যাতেই তাঁকে মলত্যাগ করতে হচ্ছিল, খুবই দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। রঘু দাস রোগ-পীড়ায় কাতর হয়ে ঘন ঘন অচৈতন্য হয়ে পড়ছিল। এ অবস্থায় তাঁর নিজেকে সাহায্য করার কোনও ক্ষমতা ছিল না। সেসময় একটি ছোট বালক রঘু দাসের সেবা করতে এল। বালকটি তাঁর দেহ-বিছানা সবকিছু পরিষ্কার করল। তাঁর দেহ সে চন্দনে প্রলিপ্ত করল এবং ঘরে সুগন্ধিত দ্রব্য দিয়ে ঘরের দুর্গন্ধ দূর করে ঘরকে শুদ্ধ হল।
রঘুর যখন বাহ্যজ্ঞান ফিরল, তখন সে দেখল বালকটি স্বয়ং জগন্নাথ। রঘু জগন্নাথকে বলল, “প্রভু তুমি এখানে কি করছ? এরকম হীন সেবা করে তুমি আমাকে অপরাধী করছ। তোমার সেবা গ্রহণ করে আমি আরও পাপগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। হে প্রভু! তুমি অত্যন্ত দয়াময়, তুমি জগতের নাথ। তুমি সবকিছুই করতে পার। তুমি যদি চাও, সহজেই আমার রোগ-পীড়া আরোগ্য করতে পারো, কিন্তু আমাকে সুস্থ করে দেওয়ার পরিবর্তে কেন তুমি আমার এমন হীন সেবা করছ?”
উত্তরে শ্রীজগন্নাথ বললেন, “হ্যাঁ, আমি সহজেই তোমাকে রোগমুক্ত করতে পারি। কিন্তু আমি তোমার সকল প্রারব্ধ কর্ম নাশ করতে চাই, যাতে তুমি দেহান্তে আমার ধামে ফিরে আসতে পারো। তাছাড়া, তোমার জানা উচিৎ যে, আমার ভক্তগণ যেমন আমার সেবা করে আনন্দ পায়, তেমনি আমিও আমার ভক্তগণের সেবা করে আনন্দ লাভ করি।” এইভাবে প্রভু জগন্নাথ ও রঘুর মধ্যে অতি অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হয়েছিল।
রঘু ছিল অত্যন্ত সরল এবং তাঁর স্বভাব ছিল ছোট বালকের মতো। শ্রীজগন্নাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ। কখনও কখনও প্রভু বালকরূপে তাঁর কাছে আসতেন তাঁরা উভয়ে একত্রে খেলা করতেন। সাধারণ লোকও জানত যে, প্রভু জগন্নাথ রঘুর সাথে খেলা করতে আসেন। প্রত্যেকেই রঘুকে সম্মান করত।
রঘু এইভাবে জনসমাজে জগন্নাথের বন্ধু বা সখা হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়েছিল।