অমিত মিত্র
করোনা ভাইরাস। মানবজাতি এবং সভ্যতাকে এক যুগান্তের সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের আর্থ-সামাজিক দিক থেকে তো বটেই; এই ভাইরাস বদলে দিয়েছে মানসিক কাঠামোকেও। অবসাদ, একাকীত্ব ক্রমেই চেপে বসছে মানুষের মনে। একা থেকে আরও একা হচ্ছে মানুষ। এখন যখন পৃথিবীতে জনসংখ্যা হেমন্তের শ্যামাপোকার মতো গিজগিজে, তখনই করোনায় একা হয়ে যাচ্ছে মানুষ। এখন আমাদের বাস নিজস্ব বুদবুদের মধ্যে। যোগাযোগহীন। যেন লক্ষ যোজন ফাঁক। নিজস্ব জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে না পারার ভিতর নিহিত থাকে এই একাকীত্বের বীজ। ‘এ জীবন লইয়া কী করিব’- এ প্রশ্ন থেকে ক্রমাগত দূরত্ব রচনাই তো আসলে জীবন। কারণ, জীবন শেষ পর্যন্ত অনিবার্যভাবে ফুরোয়। আসলে একাকীত্ববোধ কমবেশি প্রত্যেকেরই নিয়তি।
কিন্তু এই আন্তর্জালের দুনিয়ায় বাস্তবে একা হয়েও আমরা আসলে একা নয়। প্রত্যেকে ডুবে আছে তাদের নিজ নিজ মহাবিশ্বে। আন্তর্জালের ম্যাজিক রিয়্যালিটিতে। কখন এমন পরিব্যাপ্ত হল ইন্টারনেট? জালের মধ্যে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে একটা সভ্যতাকে! ভারচুয়াল আর রিয়েলের মধ্যে দৃশ্যমান ব্যবধান ঝাপসা হয়ে আসছে। একা থাকার সময়টুকুও খেয়ে নিচ্ছে নেট। ইন্টারনেট যুগে একাকীত্বের যন্ত্রণা ঘুচে গেছে। যখনই একা লাগবে, নেট খুলে বসো, গান শোনো, সিনেমা দেখো, নিউজ পোর্টালে ঢুকে পড়ো, ব্রাউজ করো, মেল করো, ই-কমার্সের কাজ সারো ঘরে বসে। সব শেষে বা সব কাজের ফাঁকে সোশ্যাল মিডিয়ার ভারচুয়াল পৃথিবী তো রয়েইছে। ভারচুয়াল বন্ধু। সঙ্গে কয়েক সহস্র ফলোয়ার। তোমার একাকীত্বের সময় কোথায়? এখানে ‘কাউকে চেনো না তুমি, তোমাকে চেনে না কেউ, এই তো ভাল…’।
হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীতে একাকীত্ব ছিল, তার যন্ত্রণা ছিল। বিরলে নিজের সঙ্গে অনেক অনেক কথা ছিল। ক্ষোভ অভিমান ছিল। আত্মরতি ছিল। জন্ম নিত নিজেকে বলার গল্প, নিজেকে শোনানোর কবিতা, গান। নিজেকে জানা- ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না’। ইন্টারনেট সেই একাকিত্ব মুছে দিয়েছে। মেটা ন্যারেটিভ আর গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ-এর যুগ ফিরে আসছে। মানুষ ছাঁচে ঢালা হয়ে উঠছে। হোমোজেনিয়াস। শক্তিশালী কেন্দ্র ক্রমশ প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে। সবজান্তা গুগল তথ্যভণ্ডার এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়। অনলাইন নজরদারিতে ব্যক্তিগত বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকছে না। সব ঝাপসা, বিচারবোধও। গড্ডলিকা প্রবাহে সমাজ চলমান। প্রত্যেকেরই অবস্থান এক এককবৃত্তে।
তবু এসব কিছু নিয়েও একাকীত্ব সরিয়ে একা থাকা যায়। যদি চার দেওয়ালের নিষেধ ভেঙে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো যায়। পাওয়া যায় কোনও নিবিড় পরশ। যদি একা লাগে, হাত রাখো অন্য কারও হাতে। দূরে থেকেও মনে মনে ছুঁয়ে থাকা যায় তেমন কাউকে। মনের গহীনে বপণ করা যায় তার আদল। কিংবা আর কিছু না হোক, ঠিক এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে একাকীত্বের মানুষ, অন্ন দাও অভুক্ত শিশুটির পাতে। দাঁড়াও এসে সহায়হীন মানুষের পাশে। তখন দেখবে, তুমি একা হয়েও আর একা নয়। নেই কোনও একাকীত্ব, নেই কোনও নিঃসঙ্গতা।