হোমফিচারজিন্দেগী না মিলেগি দোবারা, তাই বৃদ্ধাশ্রমই আজ 'সেকেন্ড হোম'

জিন্দেগী না মিলেগি দোবারা, তাই বৃদ্ধাশ্রমই আজ ‘সেকেন্ড হোম’

জিন্দেগী না মিলেগি দোবারা, তাই বৃদ্ধাশ্রমই আজ ‘সেকেন্ড হোম’

সংযুক্তা সরকার সংযুক্তা সরকার

‘স্বামী-স্ত্রী আর আলসেশিয়ান, জায়গা বড়োই কম, আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’ হৃদ্পিণ্ড এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়া নচিকেতা চক্রবর্তীর সেই গানের লাইন মনে আছে নিশ্চয়ই। আজও যে গান শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। যে গান বাজলে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে আসে, ঢোক গিলতে কষ্ট হয়। সেই গান, যে গানে ছেলেমেয়েরা স্পষ্টতই ‘ভিলেন’। শুধুমাত্র নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য যাঁরা মা-বাবাকে অবহেলায় ফেলে রাখেন বৃদ্ধাশ্রমে।

এমনটা যে আজও হয় না সেকথা অবশ্য জোরগলায় বলা যায় না। তবে এটুকু বলা যেতেই পারে যে ২০০১-এর সেই ছবিটা কিন্তু পাল্টেছে এবং অনেকটাই পাল্টেছে। তাই আজ প্রায় দু’দশক পরে ‘বৃদ্ধাশ্রম’ লিখতে বসলে শিল্পীর সেই গান কিন্তু একটু অন্য সুরে বাজতো। বাজতো, কারণ মা-বাবাদের কাছে ওল্ড-এজ হোম আজ আর শেষ বয়সের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া আশ্রয় নয়; বরং তাঁদেরই পছন্দের দ্বিতীয় জীবন, এক অন্য গৃহকোণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যে ঘর তাঁরা নিজেরাই বেছে নিচ্ছেন, সানন্দে।আরও একটু ভালো থাকার জন্যে।

শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে পড়াশোনার পাঠ শেষ করে চাকরি নিয়ে বহু বছর রাজ্যের বাইরে ঈশানি। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পেশায় অধ্যাপক। মেয়ে বড় হয়েছে, চাকরি করছে মুম্বইয়ে। হাসতে হাসতে বললেন, ‘আর মাত্র কয়েকবছর। চাকরির পাট চুকলেই বন্ধুরা মিলে ঠিক করেছি শেষ বয়সে আবার সবাই একসঙ্গে থাকবো।’ কীভাবে? ‘আমাদেরই এক বন্ধু একটা ওল্ড-এজ হোম শুরু করতে চলেছেন আমাদের প্রাণের শহর শান্তিনিকেতনে। অবসরের পরে সেখানেই থাকার প্ল্যান। কোনও ঝুট-ঝামেলা থাকবে না। মেয়ে-জামাইয়ের মুখাপেক্ষী হয়েও থাকা নেই। নিজেদের মতো থাকবো। খালি আড্ডা, গান আর কবিতায়’।

ঈশানি কিন্তু একা নন। এভাবে রীতিমতো পরিকল্পনা করে রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট প্ল্যান- এর মতোই আজকাল নিজেদের অবসর পরবর্তী জীবন বেছে নিচ্ছেন ষাট, পঁচাত্তর, নব্বইরা। সংসার ও সন্তান তাঁদের ত্যাগ করেছে বলে নয়, পরিবারের অবহেলায় লুকিয়ে রাখা কান্না চাপতেও নয়, বরং আরও খানিকটা নিরাপত্তার আশায়, স্বাধীনতার স্বাদ পেতে অথবা নিঃসঙ্গ জীবনে একটু বন্ধুত্বের ছোঁয়া খুঁজে পেতেই ওল্ড-এজ হোমগুলোতে ভিড় করছেন ওঁরা।

বহু বছর ধরে দক্ষিণ কলকাতায় একটি বেসরকারি হোম চালাচ্ছেন জয়িত্রী দাস। বললেন, এই বয়সে এসে ওনাদের যেটা সবথেকে বেশি প্রয়োজন, তা হলো ‘প্রপার কেয়ার’। অধিকাংশ ক্ষেত্রে একই বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকা সত্বেও এবং যথেষ্ট ইচ্ছে থাকলেও তাঁদের হাজার ব্যস্ততার জন্য ছেলেমেয়েরা এই কেয়ারটুকুই ঠিকভাবে দিতে পারেন না। NRI ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও বেশি। যে সমস্ত কেয়ার-গিভারদের কাছে তাঁরা বৃদ্ধ বাবা-মাকে রেখে যাচ্ছেন সেই নার্স বা আয়ারা আদৌ কতটা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত , তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাবা-মাকে দূরে রেখে নিশ্চিন্তে থাকতেও পারেন না ছেলেমেয়েরা।এই হোমগুলো কিন্তু তাঁদের কাছে অনেকটাই বড় ভরসা ও আশ্বাসের জায়গা। বাবা-মায়েরাও স্বচ্ছন্দ। কারণ, তাঁদের নিয়ে অযথা বিচলিত হতে হচ্ছে না ছেলেমেয়েকে।

কেউ আলজাইমারের পেশেন্ট, তো কারও নিয়মিত ইনসুলিন। তাই সময়মতো এবং সঠিক ডায়েট আর ওষুধ দুটোই খুব জরুরি। প্রয়োজন, চব্বিশ ঘন্টা মেডিকেল সাপোর্ট। বাড়িতে থেকে যে পরিষেবা পাওয়াটা অনেক ক্ষেত্রেই সময়সাপেক্ষ এবং একইসঙ্গে কঠিনও।’ বললেন, অন্য একটি বৃদ্ধাশ্রম, ‘আফটার কেয়ার’ কর্তৃপক্ষ।

এই সব পার্থিব সুযোগ-সুবিধের পরেও কিছু অচেনা-অজানা মানুষের সঙ্গে এক ছাদের তলায় থাকতে থাকতে যে নির্ভেজাল, অপার্থিব সুখ পাওয়া যায় এখানে সেই বন্ধুত্বের টানও তো কিছু কম নয়। বেলাশেষের সঙ্গীহীন জীবনে নতুন নতুন সবুজ পাতার মতোই এখানে ‘বন্ধু’ আসে। একসাথে খায়, গল্প করে, গান গায়, হাতের ওপর হাত রাখে। কোনও আদান-প্রদান নেই। কোনও হিসেবে কষার দায় নেই। বৃদ্ধাবাসের রোজনামচায় তাই বন্ধুতা আসে সহজভাবেই। শারীরিকভাবে অশক্ত মানুষগুলো যে বন্ধুত্বের স্বাদ কিন্তু সহজে পায় না ঘরের চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে, যার অনেকটাই জুড়ে থাকে ছোটপর্দার সিরিয়ালগুলি।

গত তিন বছর ধরে শিবাশ্রম ওল্ড-এজ হোমই ঠিকানা পূর্ণিমা মুখার্জির। হোম-এর সরস্বতী পুজোর হাজার কাজে রীতিমতো ব্যস্ত। বললেন, ‘পঞ্চাশ পেরোনোর পর মনে হলো এবার একটু নিজের মতো করে থাকি। তাই নিজেই খোঁজ খবর নিয়ে চলে এলাম।আর সেই থেকেই এখানে।’ সারা বছর পুজো পার্বণে বেশ কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। আলতো হেসে যোগ করলেন, ‘ভালো আছি। কারণ এখানে তো আমরা সবাই একইরকম। তাই না?’

আসলে প্রতিটা বয়সেরই একটা নিজস্ব যাপন আছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে নিজের মতো করে থাকার প্রবণতা। পরিবারের বাকি পাঁচজনের ভিড়ে মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে খুব। একটা দূরত্ব তৈরি হয়, স্বাভাবিক নিয়মেই। নিজের সময়, নিজের সুবিধে-অসুবিধে, ভালো-মন্দটুকু নিয়ে একটা স্বাধীন জীবনের স্বাদ পেতেও যে ইচ্ছে করে না, এমনটাও নয়।কারও মা, কারও বাবা, কারও দাদা, পিসি, কাকা হয়ে অনেকগুলো বসন্ত অনেকগুলো গ্রীষ্ম-বর্ষা কাটিয়ে, কী জানি, হয়তো ইচ্ছে করে শুধু নিজেকে নিয়ে আর নিজের মতো করেই কাটুক এই হেমন্তের দিন-রাতগুলো।

কে বলতে পারে, হয়তো কোনও এক হেমন্ত-দিনে আবারও দেখা দেবে বসন্ত। নতুন করে।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img