শ্যামল সান্যাল : তিনি গিয়েছিলেন পুরুলিয়ার পঞ্চকোট রাজবাড়িতে চাকরি করতে। বেকার কবি ওঁদের ওখানে টাকা পয়সার হিসাব, অন্য বিভিন্ন দিকে খেয়াল রাখার শর্তে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। থাকতেন ওই রাজবাড়িতেই।
বোহেমিয়ান কবি। সেকালের শক্তি চট্টোপাধ্যায়। শক্তি ছিলেন বাউন্ডুলে এক অনন্য কবি, ইনিও তাই। শক্তি জীবনে হিসেব করেন নি, মাইকেল ও তাই। শক্তি কবে কোথায় চলে যেতেন, তার কোনও ঠিক হদিশ কেউ পেতেন না। এই কলকাতায় তো, দুদিন পরে দেখা গেল সুলতানখোলার বন বাংলোতে দৃশ্য গলায় গাইছেন, ঘুরছেন নদীর পাড়ে, বনের পথে। লিখছেন, স্থানীয় বন্ধুদের সঙ্গে বসে গেছেন আড্ডায়। সঙ্গে পানীয়।
মাইকেল প্রায় নিঃস্ব, মাথায় প্রচুর ধারের বোঝা। উনি কিছু রোজগারে আশায় কলকাতা ছেড়ে অত দূরে গিয়েছিলেন। কাজকর্মে তেমন আগ্রহ কি করেই বা থাকবে তাঁর। কবিতা লিখে তিনি দুনিয়া কাঁপানোর স্বপ্ন দেখছিলেন। সেই অন্ধকার এক দূরের জঙ্গল, পাহাড় ঘেরা এক জেলায় তবু তিনি রয়ে গেলেন। তখন তো ট্রেন, গাড়ি, বাস ছিল না। গরুর গাড়ি, পালকি, নয়ত পায়ে হাঁটা। অতএব খারাপ লাগলেও , ধুর নিকুচি করেছে বলে শক্তির মত পালিয়ে যাবার চান্স ছিল না।
মাইকেল ওখানে অতি সুপরিচিত ছিলেন বিখ্যাত কবি হিসেবে। রাজারাও তাঁকে সম্মান, খাতির করতেন খুব। তখন তো রাজা, জমিদাররাই কবি, সাহিত্যিক, গাইয়ে বাজিয়েদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মাইকেল মধুসূদনের মত এক বিখ্যাত কবির জন্য তাঁরা গর্বিত ছিলেন। তিনি যে ওখানে সাহিত্য চর্চাই করতেন, তাতে তাঁদের যথেষ্ট অনুমোদন ছিল। কবি তো আর কেউ না, খোদ মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত তো কবি বটেই। কিন্তু তিনি যে বিলেত থেকে পাশ করা ব্যারিস্টারও ছিলেন।
তিনি আদলতের খাতায় ছিলেন, মাইকেল এম এস ডাট , ব্যারিস্টার এট ল ,অফ গ্রেজ ইন…।
শক্তি কোনও আইনকানুন শৃঙ্খলার ধার ধারতেন না। প্রেসিডেন্সির ছাত্র ছিলেন। আর মাইকেল হিন্দু কলেজের। সেরা ছাত্রদের একজন। খিদিরপুরের পৈতৃক বাড়ি থেকে আসতেন পালকি চেপে, সঙ্গে জন্য দুই চাকর ও কয়েক রকমের পোশাক।
কলেজেই তিনি কয়েকবার পোশাক বদলে নিতেন। শক্তি কবি তো ধনীর সন্তান ছিলেন না। বাসে ট্রামে চলাফেরা, দৌড় কফি হাউস অব্দি।
“মাইকেল হঠাৎই একদিন ধুতি চাদরের বদলে বুট ট্রাউজার ও আচকান পরিয়া আসিয়া উপস্থিত। তাহার পরেই ইংরেজি কোর্তা ধরিলেন – এ পোশাক আর জীবনে পরিত্যাগ করেন নাই ..
তাঁহার দেখাদেখি কলেজের ছাত্রদের মধ্যে উড়নীহীন একসুটের একটি দল গড়িয়ে উঠিল। উড়নী-ত্যাগীরা আঁট কোর্তা গায়ে দিয়া সগৌরবে চলা-ফেরা করিতে লাগিলেন…কলেজে মধুর সবচেয়ে প্রিয় ছিল ইংরেজি সাহিত্য ও ইংরেজির অধ্যাপক কাপতেন রিচার্ডসন।” প্রমথ নাথ বিশীর ‘মাইকেল মধুসূদন : জীবন কাব্য’ বইটির পাতা থেকে এটি জানা গেল। শক্তিকে নিয়ে এইরকম মহাপন্ডিত কিছু লিখেছেন বলে জানা যায় না অবশ্য।
ফিরে যাওয়া যাক পুরুলিয়ার গড় পঞ্চকোট, যেখানে জমে উঠেছে প্ৰেম, রাজকন্যার সঙ্গে মধুর। অসাধারণ সুন্দরী সেই কন্যা। আর মাইকেল নামের এক আগুনের গোলা। রাজকন্যে সেদিন সদ্য ফোঁটা এক ফুল। মধু তখন এক যুবক। চাপা রঙের ছিপছিপে চেহারা, মুখে সরু দাড়ি। চোখে স্বপ্ন,বিশ্ব কবি হবার। মিল্টন, টেনিসনের মত খ্যাতি, প্ৰচুর টাকা, বিত্ত, বৈভব। কলকাতায় তাঁর স্ত্রী, দুই পুত্র। জোটেনি সাফল্য, বিত্ত। কিন্তু রয়ে গেছে স্বপ্ন , রাজকীয় মেজাজ।
আঠারো শতকের মাঝমাঝি সেই সময়। বঙ্কিম এসে গেছেন, রবীন্দ্রনাথ বাজারে আসেননি। ছিলেন বিদ্যাসাগর। ওই ভদ্রলোকের দৌলতে , তাঁর দেওয়া টাকা পয়সায় মাইকেল টিকে ছিলেন। মাথায় বিপুল দেনা, হতাশা, ব্যর্থতা নিয়ে একটা মানুষ প্রেমে আবারও পড়ে গেলেন। রাজকন্যার এই কবির প্ৰতি প্রেম ছিল বাঁধন ছাড়া।
তাঁকে নিয়ে মাইকেল কবিতা লিখেছেন.. ‘হেরিনু রমারে আমি নিশার স্বপনে..,/’ ‘ভেবেছিনু, গিরিবর!রমার প্ৰসাদে, তাঁর দয়াবলে…’
‘কোথায় সে রাজলক্ষ্মী যাঁর স্বর্ণজতি , উজ্যলিত মুখ তব ?
এই প্রেমের কথা কানে গিয়েছিল রাজার। বংশ মর্যাদায় আঘাত হজম করে নেবেন রাজা ?
তাই ঠিক হলো মধুসূদনকে গুম খুনের।
রাজকুমারী কৃষ্ণা সে কথা জেনেই সোজা নিজের বিশ্বাসী লোকজনদের সঙ্গে দিয়ে মাইকেলকে রাতের অন্ধকারে পাঠিয়ে দিলেন কলকাতায়।
রাজারা সব জানলেন। এরপরে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেলেন সেই রাজকন্যা।
সে কি শোকে সুইসাইড করেছিল..? না পারিবারিক সম্মান রক্ষায় তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল ?
পুরুলিয়ার রাজ পরিবারের কেউ আজও এই ব্যাপারে মুখ খুলতে চান না। পুরুলিয়ার বাসিন্দা ও সাহিত্যিক গবেষক শ্যামল কিশোর তেওয়ারির সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, রাজ কন্যাকে খুনই হতে হয়েছিল।
প্রেমিক কবির প্রাণ বাঁচাতে মরতে হয়েছিল প্রেমিকাকে।
আজকের দিনেই মাইকেল মধুসুদন দত্ত মারা গিয়েছিলেন কলকাতায়। বেঁচে থাকলে বয়স হত
১৪৮ বছর। জন্মেছিলেন যশোরে, ১৮২৪ সালে। পার্ক স্ট্রিটের সমাধিতে ঘুমিয়ে আছেন তিনি।