ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার
রিতা আর তুতুলের অনলাইন ক্লাস চলছে সকাল দশটা থেকে। বাবা তন্ময়েরও ওয়ার্ক ফ্রম হোম। করোনার কারণে সবাই বাড়িতেই রয়েছে। ফলে স্মার্টফোন, টিভি আর কম্পিউটারই এখন সারাদিনের সঙ্গী। তুতুল ছাড়া অন্যদের চশমা আছে। তবে পাওয়ার খুবই সামান্য।
কিন্তু মুশকিল হল কিছুক্ষণ কম্পিউটার বা মোবাইল দেখবার পরেই ওদের চোখে এক ধরনের অস্বস্তি হচ্ছে। দেখার অসুবিধা ছাড়াও চোখ খচখচ করা, চোখ থেকে জল পড়া, মাথার যন্ত্রণা তো রয়েইছে। এছাড়া মাঝে মাঝেই চোখ লাল হয়ে উঠছে। পরিচিত ডাক্তারের কথামত ওষুধ আর অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং যুক্ত চশমা বানিয়ে সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়েছে।
চশমায় অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং দৃষ্টির উন্নতি ঘটায়, চোখের ব্যথা বা টনটনানি কমিয়ে দেয় আর চশমার মধ্যে দিয়ে চোখকে অনেক আকর্ষণীয় করে তোলে। চশমার লেন্সের বাইরের পিঠে (Surface) এক ধরনের রাসায়নিক আবরণ দেওয়া থাকে। এই আবরণের জন্য লেন্সের বাইরের পিঠ থেকে আলোর প্রতিফলন (Reflectin) কমে যায়। আলোর প্রতিফলন না থাকায় বেশী আলো চোখের ভিতর প্রবেশ করতে পারে, ফলে দৃশ্যবস্তুকে অনেক ভালোভাবে দেখা যায়। অল্প আলোয় এই ব্যাপারটা বিশেষভাবে বোঝা যায়। আলোর প্রতিফলন না থাকায় চশমার লেন্সটাকে প্রায় দেখাই যায় না। সেইজন্য চোখ দুটিকে সুন্দর দেখায় এবং অন্য লোকের চোখের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ (Eye Contact) করতে পারা যায়।
হাই-ইন্ডেক্স (High Index) লেন্স সাধারণ লেন্সের থেকে বেশি পাতলা। এই লেন্সে অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং থাকলে অনেক বেশী উপকার পাওয়া যায়। সাধারণ লেন্স মাত্র 8% প্রতিফলনকে প্রতিহত করে, কিন্তু অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং যুক্ত লেন্স প্রায় 99% প্রতিফলন ঠেকাতে সক্ষম। অর্থাৎ এক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক আলো বেশি পরিমাণে চোখে ঢুকতে পারে। সেই কারণেই অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং যুক্ত চশমায় অল্প আলোতেও ভালোভাবে দেখা যায়। দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটারে কাজ করতে বা গাড়ি চালানোর সময় গ্লেয়ারমুক্ত স্পষ্টদৃষ্টি চোখকে একেবারেই ক্লান্ত হতে দেয় না। চোখে কোনো সমস্যা না থাকলেও অনেকে কাজের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য পাওয়ারহীন অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং যুক্ত চশমা ব্যবহার করেন।
কীভাবে অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং করা হয়?
Vacuum Deposition প্রযুক্তিতে একসঙ্গে অনেক লেন্সে অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং বসানো হয়। প্রথমে লেন্সগুলিকে ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়। সামান্য নোংরা দাগ, সূক্ষ্ম চিড় বা ফাটা কিম্বা তুলোর আঁশ লেগে থাকলে কোটিং নিখুত হয় না। লেন্স বারবার জলে ধুয়ে আলট্রাসাউন্ডের সাহায্যে পরিষ্কার করে ওভেনে শুকিয়ে নেওয়া হয়। এরপরে লেন্সগুলিকে Coating Chamber-এ ঘূর্ণয়ামান তাকের উপর বসিয়ে চেম্বারের সমস্ত হাওয়া বার করে নেওয়া হয়। Coating Chamber-এর ভিতরে একটা আলাদা খোপে বিশেষ রাসায়নিক (Metal Oxide) পদার্থ বা Coating Material রাখা থাকে। এই Coating Material কে উচ্চগতিসম্পন্ন ইলেকট্রন কণা দিয়ে আঘাত করলে সেটি বাষ্পীভূত হয়ে Coating Chamber-এর লেন্সের উপরে সূক্ষ্ম আবরণ তৈরি করে। একেই অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং বলা হয়।
কোন অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং আপনার পক্ষে উপকারী?
বেশিরভাগ অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং-এ একাধিক সূক্ষ্ম আণুবীক্ষণিক Metal Oxide-এর আবরণ থাকে। এই আবরণের সংখ্যার উপরে অ্যান্টিরিফ্লেকশন ক্ষমতা নির্ভর করে। আবরণ যত বেশী হবে লেন্সটি তত বেশী কার্যকরী হবে। প্রতিটি আবরণ আলাদা আলাদা আলোর রিফ্লেকশনকে প্রতিহত করে। কোন কোটিং আপনার পক্ষে উপকারী, তা নির্ভর করে আপনার কাজের ধরনের উপর। কম্পিউটার, স্মার্টফোন, ই-রিডার, ঘরের LED আলো ইত্যাদি সমস্ত ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি থেকে ক্ষতিকারক নীলরশ্মি বিচ্ছুরিত হয়। সুতরাং নীল আলোর রিফ্লেকশন প্রতিহত করতে পারে এমন অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং আপনার পক্ষে উপকারী।
অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং যুক্ত লেন্সের যত্ন
লেন্সের উপরের অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং–এর আবরণ খুবই সূক্ষ্ম। মাত্র 0.2-0.3 মাইক্রন পুরু। লেন্সকে শুকনো কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করবার চেষ্টা করলে লেন্সে আঁচড় পড়তে পারে। এজন্যে প্রথমে লেন্সটিকে ভিজিয়ে নিয়ে তারপরে নরম কাপড়ের টুকরো দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। সাধারণ লেন্স পরিষ্কার করবার রাসায়নিক ব্যবহার না করাই উচিত। মনে রাখতে হবে, এই লেন্সের উপরে সামান্য আঁচড়ের দাগ সাধারণ লেন্সের চাইতে বেশী বোঝা যায়। যখন ব্যবহার করছেন না তখন এই ধরনের চশমা নির্দিষ্ট বাক্সে রেখে দিতে হবে।
অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং এর উপকারিতা :
অল্প আলোয় আরও ভালোভাবে দেখা যায়।
চোখ সহজে ক্লান্ত হয়না।
কম্পিউটারে গ্লেয়ার কমায়, চোখের ক্লান্তি দূর করে।
সন্ধ্যার পরে গাড়ি চালাতে সুবিধা হয়।
চশমার লেন্সকে প্রায় দেখাই যায় না।
বাইরে থেকে চোখের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলে।
চশমার সৌন্দর্য বাড়ায়।
ফ্যাশন দুরস্ত মানুষের প্রথম পছন্দ।
সানগ্লাসে ব্যবহার করলে রোদের গ্লেয়ার কমায়।
অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং-এর অপকারিতা
সহজেই লেন্সে আঁচড়ের দাগ পড়ে যায়, ফলে লেন্সকে নোংরা দেখায়।
লেন্সকে না ভিজিয়ে পরিষ্কার করবার চেষ্টা করলে লেন্সে দাগ পড়ে যায়।
ছোটো ছেলেমেয়েরা বারবার চশমা পরিষ্কার করতে চায়, এতে কোটিং নষ্ট হয়ে যায়।
কেবলমাত্র রিডিং গ্লাস হিসাবে ব্যবহার করা অযৌক্তিক।
Crizal- এক ভ্রান্ত ধারণা :
পাওয়ার প্রেসক্রিপশন হাতে পেয়ে দোকানে গিয়ে অনেকেই Crizal লেন্সের চশমা বানাতে চান। তারা মনে করেন Crizal একটি দামি Brand এর লেন্স। আসলে Crizal কোনও লেন্স নয়, এটি এক বিশেষ Anti-Reflection কোটিং যা যেকোন Brand এর লেন্সের উপরে লাগানো যায়। এই কোটিং লেন্সকে মসৃণ রাখে, Glare কমায়, লেন্সের উপরে ধুলোবালি বা জলের ছিটের দাগ বসতে দেয় না। এর উপরে এমন এক Varnish এর প্রলেপ দেওয়া থাকে যা লেন্সকে Scratch বা আঁচড়ের আঘাত থেকে রক্ষা করে। আধুনিক Crizal Prevencia কোটিংযুক্ত লেন্স সূর্যের ক্ষতিকারক UV এবং Blue-Violet রশ্মি থেকে চোখকে রক্ষা করে।
কি করে বুঝবেন আপনার লেন্সে সত্যিকারের Crizal কোটিং আছে কিনা?
প্রত্যেকটি Crizal লেন্সে একটি Fog-ID থাকে। লেন্সে হালকা ভাবে ফুঁ (Blow) দিলে যে কুয়াশার আবরণ পড়ে তার ভিতর ওই Fog-ID ফুটে ওঠে। কুয়াশার মিলিয়ে গেলে Fog-ID টিও মিলিয়ে যায়। প্রতিটি Crizal কোটিং-এ সাধারণত এক বছরের Warranty থাকে।
নীল আলোর ভ্রান্তি (Blue Ray) :
স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ট্যাব, টিভি ইত্যাদি থেকে একধরনের নীল আলো বিচ্ছুরিত হয়। ঘরের LED বাল্ব থেকেও নীল আলো বেরোয়। বেশি মাত্রায় এই ধরনে আলো চোখের পক্ষে ক্ষতিকর। এর ফলে ড্রাইআই, চোখের ক্লান্তি, ম্যাকুলার ডিজেনারেশন এমনকি ছানিও হতে পারে। কাজের জন্য যাদের বেশিক্ষণ ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়, তাদের চশমার লেন্সে নীল আলো প্রতিরোধক আবরণ থাকা প্রয়োজন।
সাবধানতা :
কাজের ফাঁকে ফাঁকে চোখকে বিশ্রাম দিন।
ডাক্তারের পরামর্শ মত ল্যুব্রিকেন্ট ড্রপ চোখে লাগান।
চোখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দিন।
দূরের দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন চোখের পলক ফেলুন।
অন্ধকার ঘরে স্মার্টফোন বা ল্যাপটপে কাজ করবেন না।
প্রচুর জল পান করুন।
পুষ্টিকর খাবার চোখের পক্ষে উপকারী।
গাড়ি চালানো বা কম্পিউটারে দীর্ঘক্ষণ কাজ করবার বা সময় অ্যান্টিরিফ্লেকশন-যুক্ত লেন্স উপকারী।
যথাযত যত্ন না করলে অ্যান্টিরিফ্লেকশন-যুক্ত লেন্সে আঁচড়ের দাগ পড়তে পারে।
চশমার লেন্সে অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটিং মুখের সৌন্দর্য বৃধি করে।
চশমার লেন্সে নীল আলো প্রতিরোধক আবরণ থাকা বাঞ্ছনীয়