দেবদাস কুণ্ডু
কতো লেখক কতো শিল্পী
এঁকেছেন মানুষের ছবি
গঙ্গা অজুর্ন বিবর
আমি দেখেছি মানুষ সুন্দর।
চার ফুট ছয় ইঞ্চি। ফর্সা। রোগা। নাম অন্নপূর্ণা পাল। আমার শাশুড়ি। নয় সন্তানের জননী। পাঁচ মেয়ে। দুই ছেলে। স্বামী হোশিয়ারি কারখানার লেবার। হঠাৎ কলকাতা জুড়ে হোশিয়ারি শিল্পে স্ট্রাইক। অন্নপূর্ণা পালের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। এখন তিনি কি করবেন? বড় ছেলে পড়ে এগারো ক্লাস। বড় মেয়ে পড়ে বি কম। বাকি ছোটো ছোটোগুলি পড়ে নীচু ক্লাসে। একদিন চন্দন এসে বলল, “বৌদি তুমি বেশি চিন্তা করো না। তুমি ছেলেকে আলমারি কারখানায় লাগিয়ে দিও। রোজ তিরিশ টাকা। বড় মেয়ে দুটোকে সেলাই মেশিন তুলে দাও। ওরা মেয়েদের জামা কাপড় বানাবে। ভালো আয় হবে। তুমি নিজে সায়া সেলাই করো। আমার চেনা জানা একজন সায়ার ব্যবসা করে। ওকে বললে মাল দেবে। ঘরে তো একটা মেশিন রয়েছে। যা আয় হবে তা দিয়ে তোমার মোটামুটি চলে যাবে।”
অন্নপূর্ণা পাল বললেন, “তুমি চাইছো আমার ছেলে মেয়েরা পড়াশনা বন্ধ করে কাজে লেগে পড়ুক। তাই তো?”
চন্দন বলল, “বন্ধের বাজারে তুমি কি করে লেখাপড়া চালাবে? তার জন্য তো টাকা লাগে। তা এখন খাবে? না পড়াশুনা করবে? কতদিন স্ট্রাইক চলবে তুমি জানো না। তাই বলছিলাম।”
অন্নপূর্ণা পাল ঐ কঠিন দারিদ্র্যর মধ্যে কঠিন গলায় বললেন, “দেখ তোমার কাছে আমি সাহায্যের জন্য যাইনি। তুমি যেচে তোমার মেজদার কথা ভেবে উপদেশ দিতে এসেছো। ভালো কথা। কিন্তু কু-উপদেশ দিচ্ছো কেন?”
“আমি কু-উপদেশ দিলাম?”
“ঐ যে বললে না, লেখাপড়া ছেড়ে কাজে লাগিয়ে দিতে। লেখাপড়া করার আর দরকার নেই।”
“অন্যায় তো কিছু বলিনি?”
“বলোনি?”
“না। মেজদা চিরকাল হোশিয়ারি কারখানার কাজ করে এলেন। এই বয়সে তিনি নতুন কি কাজ করবেন? কে দেবে কাজ?”
“দেখ, তুমি সরকারি চাকরি করো। কেন না তুমি এইট পর্যন্ত পড়েছিলে। তাই আজ ওবিসি কোটায় চাকরি করছো। চাকরি না পেলে তোমায় ঠাকুর বেচে খেতে হতো। সে তুমি কি করে লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে বললে?”
“দেখ আমার ব্যাপারটা আলাদা। তোমার এখন কঠিন সমস্যা। তাই–“
“দেখ তুমি মুখে বলো আর না বলো, লেখাপড়া দরকার’ এটা তুমি নিজের জীবনে বুঝতে পেরেছো। তারপর তোমার এই পরামর্শ আমাকে অবাক করছে।”
“তুমি কি জানো কতদিন এই স্টাইক চলবে? জানো না। ততদিন তুমি বাঁচবে কি করে?”
“লড়াই করে?”
“আমিও তো সেই লড়াইয়ের কথা বলছি।”
“মোটেও না। জীবনের কাছে হেরে যাবার কথা বলছো।”
“তুমি তো বড় বড় কথা বলছো বৌদি।”
“কেন বলবো না? আমি স্বপ্ন দেখি,আমার ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া শিখে একদিন চাকরি করবে?”
“স্বপ্ন দেখা ভালো। তবে সেই স্বপ্ন পূর্ণ হবে কিনা, সেটা ভেবে দেখেছো?”
“স্বপ্ন পূর্ণ করে মানুষ। তার জন্য চাই স্বপ্নকে ভালোবাসা। তাকে বুকের আগুনে ওম দেওয়া, স্বপ্নের পিছনে ছোটা। এর জন্য চাই শিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে লড়াই করতে শেখায় এবং একদিন অন্ধকার কেটে ভোরের আলোর সামনে দাঁড় করায়।যার শিক্ষা নেই, তার লড়াই নেই। সে কোনদিন লড়াই জয়ের আনন্দ পাবে না। তার মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই চলবে।”
“এতো কথা তোমাকে কে শেখাল বৌদি?”
“আমার বাবা। তিনি বলতেন স্বপ্ন দেখ। স্বপ্ন দেখ। স্বপ্ন দেখ। যে স্বপ্ন দেখে, সে একদিন মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখে। যার কোনও স্বপ্ন নেই, সে মানুষ মরা।
“আর কি বলতো তোমার বাবা শুনি?”
“বলতেন শুধু স্বপ্ন দেখলে হবে না। তাকে বুকের ভিতর লালন পালন করতে হবে সন্তানের মতো। হয়তো সেই সময় রক্ত পাত হবে। কিন্তু সারাজীবনের রক্তপাত তো বন্ধ হবে।”
“তুমি কতো দূর পড়ছো শুনি?”
“আমি আর কতটুকু পড়েছি? খবরের কাগজ পড়তে পারি। বাবা মারা গেল। বিয়ে দিল বারো বছরে। তুমি তখন ছোটো। কিন্তু এটা বুঝেছি লেখাপড়া হলো হার্ট। যে চলে বলে আমরা বেঁচে আছি। সেটা বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ মরে যায়। তুমি আমাকে সেই মরার কথা বলতে এসেছো? একটা কথা জেনে রাখবে, আমরা কখনো তোমার দরজায় হাত পাতবো না। তোমার সেই চিন্তা করতে হবে না। আর আমার ঘরে কোন দিন আসবে না।”
চন্দন হাসতে হাসতে বলল, “এই তো তুমি বাড়াবাড়ি করছো?”
“যদি তোমার তাই মনে হয়, তাই। তুমি এখন আসতে পারো। দরকার হলে তোমার মেজদা ঐ বাজারে সব্জি নিয়ে বসবে। লড়াইয়ের কোনও বয়স নেই। কেন সে অন্য কাজ করতে পারবে না?”
আমি এসব শুনেছি আমার স্ত্রীর কাছ থেকে। যখনই আমি মানুষটাকে দেখি আমার মনে হয় চার ফুট ছয় ইন্চি নয়। মানুষটা আসলে সাত আট নয় – – ফুটের মানুষ।