জর্জ ফাহরিয়ন, উহান
(এই প্রতিবেদনটি ২৬ জানু্য়ারি উহান ছাড়ার আগে লিখেছেন সাংবাদিক জর্জ ফাহরিয়ন। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে জার্মান পত্রিকা ডার স্পিগেল–এর ইংরেজি সংস্করণে। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সুচিক্কণ দাস।)
২৬ জানুয়ারি, ২০২০, উহানের সময় ২৩টা ৪৫
বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে আটটা নাগাদ খারাপ খবরটা পেলাম। সবে ঘুম থেকে উঠেছি। হোটেলের ফোনটা বাজতে শুরু করল। আমার মহিলা সহকর্মী উ দানদান ফোনে বললেন, ‘একটা সমস্যা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ উহান শহর পুরোপুরি বন্ধ করে দিচ্ছে। সকাল ১০টার পর এই শহর থেকে আর কাউকে বেরোতে দেওয়া হবে না।’ দানদান বেজিংয়ে ডার স্পিগেল পত্রিকার দপ্তরে কাজ করেন। তাঁকে নিয়েই আমি উহানে এসেছিলাম।
এরকম একটা খবর যে কোনও লোককেই ঝটপট সজাগ করে তোলে। উহানের জনসংখ্যা ১ কোটি ১০ লক্ষ। মনে করা হচ্ছে, এই শহরই নতুন করোনা ভাইরাস-এর উৎপত্তি স্থল। এই শহরেই সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মনে করা হচ্ছে, এই ভাইরাস পুরোপুরি সক্রিয় হতে সময় লাগে ১২ দিন। তার মানে আজই যদি আমরা উহান ছাড়তে না পারি, তাহলে গ্রাউন্ড জিরোতে আমাকে কয়েক দিন তো বটেই, থেকে যেতে হবে কয়েক সপ্তাহ। এমনকি কোয়ারানটাইন হয়েও থাকতে হতে পারে।
আগের দিন মানে বুধবারই বেজিং থেকে উহানে এসে পৌঁছেছি আমরা। লক্ষ্য, সরেজমিনে উহানের হাল হকিকৎ দেখা। ভেবেছিলাম ট্রেন স্টেশন, বাজার, হাসপাতাল, বিমানবন্দর সব ঘুরে দেখব। কারণ ভাইরাসটা যখন ছড়াচ্ছে, তখন চিন জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ নতুন চান্দ্র বর্ষ উদযাপনের জন্য তৈরি হচ্ছেন। এই সময় এত লোক বেড়াতে যান যে দৃশ্যটা হয় ক্রিসমাসের সময় ইউরোপের মতো। উহান চিনের অন্যতম পর্যটন হাব। এমন একটা শহরকে যখন মহামারীর মুখোমুখি হওয়ার জন্য , ভয়ঙ্কর দুর্গতির জন্য তৈরি হতে হয়, তখন শহরটার ছবি কেমন হয়?
উহানে পৌঁছে বিমানবন্দরে যে ট্যাক্সি চালকের সঙ্গে আমাদের দেখা হল তিনি খোশ মেজাজেই ছিলেন। গত তিন ঘণ্টা পর আমরাই প্রথম যাত্রী। অন্যদিনের তুলনায় দ্বিগুণ সময় যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন। এই কদিন উহানে কম পর্যটকই আসছেন, জানালেন তিনি। হাইওয়েতে যখন গাড়ি চলছিল, তখন টানা কয়েক কিলোমিটার অন্য কোনও গাড়ি চোখে পড়েনি। আমাদের ট্যাক্সিচালক বললেন, উহানের অনেক বাসিন্দার বাড়ি গ্রামে। নববর্ষ উপলক্ষ্যে তাঁরা সবাই গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন।
তবে শহরে পৌঁছনোর পর বাড়ল গাড়িঘোড়ার সংখ্যা।
উহানে শীত ছিল ভালই। ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছিল। তাপমাত্রা ছিল ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমার ফোনের অ্যাপে দেখলাম, বাতাসের গুণমান দেখাচ্ছে লাল রঙের, মানে ‘অস্বাস্থ্যকর’। তবু গাড়ির চালক জানলার কাচ নামিয়ে রাখলেন। বললেন, তাজা বাতাস আসুক একটু। এটাই ওই গাড়ি কোম্পানির নীতি। চালকের মতে, যতটা জানা যাচ্ছে তার চেয়েও বেশি মানুষ সংক্রামিত। মারাও গেছেন অনেক বেশি।
শহরের বেশির ভাগ লোকের মতোই আমরা পরেছিলাম বড় মেডিক্যাল মাস্ক। তাতে মুখ ও নাক ঢাকা। এটাই ভাইরাসের প্রথম, ছোট্ট জয়। কারণ মাস্কে ঢাকা পড়েছে উহানেন মানুষের মুখ। মাস্কের রবারের স্ট্র্যাপ দুটো দু কানে চেপে বসেছিল। ওই জায়গাটার চামড়া হয়ে উঠছিল আঁঠালো। তবুও শুধু খাবার সময় হলেই মাস্কটা খুলছিলাম। যখন দরজার হ্যান্ডেলে হাত দিচ্ছিলাম, তখনই ডিসইনফেকট্যান্ট দিয়ে হাত ধুতে হচ্ছিল। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা একজনের সঙ্গেও হাত মেলাইনি। এটাই ভাইরাসের দ্বিতীয় জয়— লোকেরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন, সকলেই সন্দেহবাতিকগ্রস্ত।
শহরের হাসপাতালের ডাক্তার ও জীবাণুবিদ্যা বিশারদদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও লাভ হল না। শুনলাম, সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যে প্রেসের সঙ্গে কেউ কথা বলতে পারবেন না। পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি রাখার জন্যই এটা করা হয়েছে। ফলে আমরা গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিকে। ১ নম্বর ভবনের হলে রয়েছে সংক্রামক রোগের বিভাগ। কয়েকজন মাত্র রোগী ছিলেন। তবে বেশির ভাগ বেড খালি।
বরং যাঁরা জ্বরে ভুগছিলেন তাঁদের ভিড় দেখা গেল অ্যাডমিশন বিভাগে। লবিতে ভিড় করেছিলেন প্রায় ২৫ জন পুরুষ ও মহিলা। প্রয়োজনীয় পোশাক পরে ছিলেন নার্সরা। তাঁদের মুখের সামনে প্লাস্টিকের আচ্ছাদন। তাঁরা রোগীদের কাছ থেকে প্রশ্ন করে তথ্য সংগ্রহ করছিলেন। বন্ধুর সঙ্গে এসেছিলেন বছর চল্লিশের এক ব্যক্তি। তিনি বললেন, চিকিৎসা সংক্রান্ত সব কাজ চলছে দ্রুতগতিতে ও শৃঙ্খলা সহকারে। জানালেন, ওঁরা আধ ঘণ্টা আগে পৌঁছেছেন, এবং এরই মধ্যে পরীক্ষার জন্য তাঁর বন্ধুর রক্ত সংগ্রহ করা হয়ে গেছে।
এবার গেলাম হ্যাংকাউ স্টেশনে। প্রথমে কথা হল একজন ট্রেনি নার্সের সঙ্গে। উনি মিউনিসিপ্যাল লাং ক্লিনিকের ইন্টার্ন। স্টেশনে এসেছেন টিকিট বদলাতে। কারণ আগামিকালের বদলে আজই বাড়ি ফিরে যেতে চান। যে হাসপাতালে উনি কাজ করেন সেখানে চাপা উদ্বেগ রযেছে । কারণ অনেক লোক এই ভাইরাসে আক্রান্ত। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় বেড অল্পই। তাঁর পরামর্শ, খুব বেশিক্ষণ এখানে থাকবেন না।
শহরে একেবারে শুনশান এলাকাটা ছিল হুয়ানান বাজার। বিশাল এই বাজার কয়েকদিন আগেই ছিল জমজমাট। লোকেরা কিনতে পারতেন মাছ, কাঁকড়া, মুরগি এবং অন্যান্য প্রাণির মাংস। এই বাজারই হল মহামারীর কেন্দ্র। এই বাজারের আশপাশের এলাকা থেকেই ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসে প্রথম সংক্রমণ ঘটে। সংক্রামিতরা হলেন নাগরিক এবং বন্যপ্রাণ ব্যবসায়ী। অভিযোগ, এই বাজারে নেকড়ের বাচ্চা, সাপ ও ভাম বিড়ালও বিক্রি হয়। তবে এখন গেটের ওপারে সব দোকান বন্ধ। শাটার ফেলা। বাজারের পাশের রাস্তাটাও শুনশান।
উহান শহরের পরিবেশটা ঠিক কী রকম তা বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। চারপাশে কেমন যেন ভয় ভয় ভাব। তবে অনেকে মাস্ক ছাড়াও ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বছরের এই সময় গাড়িঘোড়া যতটা থাকা দরকার চলছে তার চেয়ে কম। তবে শহরটা মোটেই স্তব্ধ হয়ে যায়নি। দেখে মনে হয় শহরটার অবস্থা ন যযৌ, ন তস্থৌ ধরনের। মনে হয়, বিষয়টার প্রভাব বোধগম্য করার চেষ্টা চালাচ্ছেন মানুষ।
বুধবার রাত দুটোর সময় শহর কর্তৃপক্ষ ঠিক করেন যে গোটা উহান শহর তালাবন্ধ করে দেওয়া হবে। তখন আমরা তো বটেই, গোটা শহর ঘুমে আচ্ছন্ন। সকালে সেখবর পাওয়ার পর আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা। তাহলে কি গাড়িতে করে শহর ছাড়ব? যদি ঠিক সময়ে শহর ছাড়তেও পারি তাহলেও উহানের নম্বর প্লেট লাগানো গাড়ি করে আমাদের কি আরও দূরে যেতে দেওয়া হবে? ঠিক করলাম, বিমানবন্দরেই যাব। যদিও টিকিট পাওয়ার সুযোগ প্রায় নেই। সকাল ১০টার আগে উহান ছাড়বে এমন সব বিমানের টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। ক্রমশ ভয় হতে লাগল যে, আমাদের হয়ত ১ কোটি ১০ লক্ষ মানুষের এই শহরে আটকে পড়তে হবে। এবং শহরবাসীদের অনেকেই এই ঘাতক ভাইরাস বয়ে বেড়াচ্ছেন।
১৫ মিনিট পর আমরা একটা ট্যাক্সিকে আটকাতে পারলাম। চালক বললেন, মিটারে যাবেন না। ভাড়া লাগবে ২০০ ইউয়ান। প্রায় ২৬ ইউরো। বুধবার যে ভাড়া লেগেছিল তার প্রায় দ্বিগুণ। বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখি পুলিশের একগাদা কালো ভ্যান চারপাশ ঘিরে রেখেছে। মানে, টিকিট না পেয়ে যাত্রীরা অশান্তি বাঁধানোর চেষ্টা করলে কড়া হাতে দমন করা হবে পরিস্থিতি।
ডিপার্চার বোর্ডে দেখি প্রায় সবটাই লাল। বেশির ভাগ উড়ান বাতিল করা হয়েছে। আমার সঙ্গী দানদান বলল শিয়ামেন এয়ারের চেকইন ডেস্কে যেতে। ইতিমধ্যে ও স্মার্টফোনে দুটো টিকিট কেটে ফেলল। উড়ান বেলা ১১টা ০৫ মিনিটে। যাবে কুইংহাই প্রদেশের রাজধানী শিনিং। জায়গাটা চিনের পশ্চিম দিক। এখান থেকে বেজিংয়ের উড়ান আর ছাড়ছে না। বিমানকর্মীরা আমাদের দুটো বোর্ডিং পাস দিলেন। বললেন, যদি বিমানটা ফেরত আসে তাহলে পাস ফেরত দেওয়া যাবে।
শেষ পর্যন্ত দুজনে বিমানে আমাদের আসনে গিয়ে বসলাম। সম্ভবত সেদিন উহান থেকে ছাড়া সেটাই শেষ উড়ান। কর্ডন ভেঙে পালিয়ে তো এলাম। সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ার এক ঘণ্টা পর।