শনিবার রাতে পূর্ব বর্ধমানের শক্তিগড়ে খুন হয় কুখ্যাত কয়লা মাফিয়া রাজেশ ঝা ওরফে রাজু। কয়লাকাণ্ডে তাঁর বয়ান রেকর্ড করার জন্য সোমবার ডেকে পাঠিয়েছিল এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট। শনিবার সন্ধ্যায় রাজু তাঁর দুর্গাপুরের বাড়ি থেকে কলকাতার পথে রওনা দিয়েছিলেন। গাড়িতে চালকের পাশের আসনে বসেছিলেন রাজু। সঙ্গে ছিলেন ব্যবসায়ী তথা তাঁর সহকর্মী অণ্ডাল থানার দক্ষিণখণ্ডের বাসিন্দা ব্রতীন মুখোপাধ্যায়। বর্ধমানে শক্তিগড়ে ল্যাংচা হাবের কাছে দোকানের সামনে পরপর গুলি চালিয়ে খুন করা হয় রাজুকে। যে গাড়িতে তিনি ছিলেন সেটি আবার গরু পাচার চক্রের অন্যতম পাণ্ডা আব্দুল লতিফের বলে জানা গেছে।
কে এই রাজু ঝা? ৮০-৯০ দশকের কয়লা মাফিয়া সুরজু উপাধ্যায়ের ট্রান্সপোর্টের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল এই রাজু। প্রথমদিকে কয়লার ট্রাকের খালাসির কাজ করতে করতে হাত পাকাতে শুরু করে।
সুরজের মৃত্যুর পর অলিখিতভাবে তাঁর কারবারের বেতাজ বাদশা হয়ে ওঠে রাজু। গোটা কারবারই তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ২০০০ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত তাঁর কয়লার কারবার রীতিমতো ফুলেফেঁপে ওঠে। রানিগঞ্জ থেকে ডানকুনি পর্যন্ত একচেটিয়া কয়লার প্যাড তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল। কয়লার কালো কারবারে হাত পাকিয়ে রাজু হয়ে ওঠে ‘ব্যবসায়ী’।
আসানসোলের জামুড়িয়া, বারাবনি এলাকায় রাজুর বিশাল প্রতিপত্তি ছিল। রাজনৈতিক নেতা থেকে এক শ্রেণির পুলিশ অফিসারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে কয়লা পাচারে ভিন রাজ্যেও নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করে রাজু।
রানিগঞ্জের পাঞ্জাবি মোড় এলাকায় ২ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশেই রানিগঞ্জের ৬ এবং ৭ নম্বর কলোনি। এখানেই রাজুর বাড়ি। পরে রানিগঞ্জ ছেড়ে দুর্গাপুরে চলে এসেছিলেন।
স্থানীয় সূত্রে খবর, ২০১৫-১৬ সাল নাগাদ রানিগঞ্জ ছেড়ে পরিবার নিয়ে রাজু পাড়ি দেয় দুর্গাপুরে। সেখানে একের পর এক ব্যবসা শুরু হয়ে যায়। রেস্তোরাঁ, হোটেল, ট্রান্সপোর্ট, পার্কিং জোন, শপিং মলের ব্যবসায় আরও ফুলেফেঁপে ওঠে রাজু। দুর্গাপুরের সিটি সেন্টারে তাঁর বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ, শাড়ির দোকান রয়েছে।
আসানসোল ও দুর্গাপুর থেকে কলকাতার ধর্মতলা ও করুণাময়ী রুটে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত প্রথম ভলভো বাস পরিষেবা চালু হয় রাজু ঝা-র হাত ধরেই৷ এরপর হোটেল ব্যবসা সহ একাধিক জায়গায় বিনিয়োগ করেন তিনি৷
রাজুর আদি বাড়ি ছিল বিহারের দ্বারভাঙা জেলায়। শৈশবেই বাবা-মায়ের সঙ্গে তার রানীগঞ্জে আসা। রানিগঞ্জের মারওয়াড়ি স্কুলে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়াশোনা। তারপর ঢুকে পড়েছিলেন কয়লার কারবারে। কাজ শুরু করেছিলেন কয়লার ট্রাকের খালাসি হিসেবে। একসময় সাইকেল চুরিতেও তাঁর নাম জড়িয়েছিল।
সামান্য কয়লা খালাসি থেকে এলাকার ‘ডন’ হয়ে ওঠা, রাজুর নজরকাড়া উত্থান বাম জামানাতেই। কয়লা সংক্রান্ত নানা অভিযোগে ২০১১-এর ৩ জুলাই রাজুকে রানিগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০০৬ সালেও একবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন রাজু।
২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে দুর্গাপুরে সভা করেছিলেন BJP নেতা দিলীপ ঘোষ এবং ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিং। দুর্গাপুরের পলাশডিহার সভামঞ্চে অর্জুন সিং ও BJP-র পশ্চিম বর্ধমান জেলা সভাপতি লক্ষ্মণ ঘোড়ুইয়ের হাত থেকে দলীয় পতাকা নিয়ে গেরুয়া শিবিরে নাম লেখান রাজু। সেই সময় মঞ্চ থেকে রাজুর পরিচয় দেওয়া হয় ‘বিশিষ্ট সমাজসেবী’ হিসেবে। এই নিয়েও বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে।
সূত্রের খবর, বাম আমলে শাসকদলের সঙ্গেও তাঁর রীতিমতো ঘনিষ্ঠতা ছিল। কয়লা কান্ডে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সক্রিয় হতেই ধীরে ধীরে বিজেপির রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশের ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে এক সময়ের খনি অঞ্চলের কালো হীরের কালো সাম্রাজ্যের ‘বেতাজ বাদসা’ রাজু ঝা।