হোমসাহিত্য-সংস্কৃতিব্রত,  আলপনা এবং বাংলার সাংস্কৃতিক শিকড়

ব্রত,  আলপনা এবং বাংলার সাংস্কৃতিক শিকড়

ব্রত,  আলপনা এবং বাংলার সাংস্কৃতিক শিকড়

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
দশপুতুল ব্রতের আলপনা
: চৈত্র সংক্রান্তি থেকে বৈশাখ সংক্রান্তি পর্যন্ত পালিত হয় দশপুতুল নামে মেয়েলি ব্রত। তারই অনুষঙ্গে পিটুলি গোলা দিয়ে আঁকা হয় পুতুলি, যার পূর্বসূত্র আদিমমানবের গুহাচিত্র, যেখানে সহজ রেখায় অঙ্কিত হয়েছিল মানব মূর্তির অবয়ব। আলপনা হয়ে তারই অনুবর্তন পরে প্রতিফলিত হয়েছে আজকের পুতুল নির্মাণ শৈলীতে। এই ব্রতের আলপনায় পৌরাণিক চরিত্র যেমন রাম-সীতা, হর-পার্বতী প্রভৃতি দশটি পুতুল আঁকা হয়। পুতুলে ফুল-দূর্বা ছুঁয়ে মনোবাসনার কথা প্রকাশ করা হয় — রামের মতো স্বামী চাই, সীতার মতো সতীসাধ্বী স্ত্রী হতে চাই ইত্যাদি। পারিবারিক সুখসাচ্ছন্দ্য, শান্তি স্বস্তির জীবনাকাঙ্ক্ষা এই ব্রতের উদ্দেশ্য। আলপনার কেন্দ্রে পদ্মের ঠাঁট যা নারী অঙ্গের প্রতীক, যেমন দশদল পদ্ম। বাইরে হাত ধরাধরি করে দশটি পুতুল আঁকা; হাতে হাত ধরা মানে পরিবার কেন্দ্রিকতা। প্রার্থনা এই সর্বসুখ, সর্ব-বাসনা চরিতার্থ হোক সমবেতভাবে, সমন্বিতভাবে। আলপনার সীমানা জুড়ে কলামণ্ডনের নান্দনিকতা; চার কোণায় জড়ানো বৃত্ত, সংসারে জড়িয়ে থাকার আর্তি, জীবনানন্দের পূর্ণতা৷

পৃথিবী ব্রতের আলপনা
বাংলার কুমারী মেয়েরা পরপর চার বছর ধরে চৈত্র সংক্রান্তি থেকে বৈশাখ সংক্রান্তি পর্যন্ত এই ব্রত পালন করে। সংসারের যাবতীয় মঙ্গল কামনাই মূল উদ্দেশ্য, এমনকি সমগ্র পৃথিবীর মঙ্গলও। উঠোন জুড়ে অথবা মেঝেতে পিটুলি গোলা দিয়ে আঁকা হয় পদ্মের বন। তার মধ্যে আঁকা হয় ধরিত্রীমাতা বা পৃথিবী দেবী৷ পুজোর উপচার ও উপকরণগুলি মন্ত্র পড়ে তিন বারের জন্য ঢেলে দেওয়া হয় আলপনার উপর। যেন পৃথিবী শান্তি পায়, অসুখ দূর হয়, মানুষও সুখী হয়৷

বসুধারা ব্রতের আলপনা
চৈত্র সংক্রান্তির দিনটি থেকে শুরু হয় বসুধারা ব্রত। গ্রীষ্মের চরম দাবদাহকে মনে রেখেই এই ব্রত। গৃহাঙ্গনে রোপিত গাছগুলিকে সূক্ষ্ম জলের ধারা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার এক হিন্দু ব্রত ও আচার। ”বসুধারা’ মানে পৃথিবী অথবা পৃথিবীর জল-সম্পদের স্রোত। বিবাহ উপলক্ষে সনাতনী হিন্দুর গৃহে দেওয়ালে আঁকা হয় সিঁদুরবিন্দুসহ ঘিয়ের পাঁচটি অথবা সাতটি স্রোত, তাকেও বসুধারা বলে। বসুধারা কথাটির মধ্যে রয়ে গিয়েছে প্রবাহের অনুভূতি।

ভারতের নারীরা পারিবারিক মঙ্গলের জন্য চৈত্র সংক্রান্তি থেকে টানা একমাস তুলসীমঞ্চে তুলসীধারার ব্যবস্থা করেন। একটি মাটির হাঁড়িতে তলায় ছোটো একটি ফুটো করে, তাতে পলতের কাপড় প্রবেশ করিয়ে অতি ধীর ধারায় সেচের বন্দোবস্ত করেন তারা, একে বিন্দুপাতি সেচ বলা যেতে পারে, ইংরাজীতে  Drip Irrigation। ভারতীয় নারী যে বসুধারা ব্রত পালনের অঙ্গ হিসাবে স্নান সেরে সেই ঝারায়  জল ঢালেন এবং তুলসী পূজন করেন তাও তুলসী নামক এক পবিত্র ও ভেষজ উদ্ভিদের প্রতি ধন্যবাদাত্মক চিন্তন।

বসুধারা ব্রতের উদ্দেশ্য বসুধা বা পৃথিবীকে উর্বরা এবং শস্য-সবুজ করে তোলা। ফসলের জন্য জল চাই, জলের জন্য বৃষ্টি চাই, বৃষ্টির জন্য মেঘ। বঙ্গদেশকে মেঘালয় করে গোলার কামনার নামই বসুধারা ব্রত। বসুধারা ব্রতের আলপনায় তুলসীমঞ্চের ঠাঁট সহ তুলসীগাছ আঁকা হয়। আর আঁকা হয় স্বস্তিক চিহ্ন এবং তুলসীমাতার ছবি।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার বিভাগের অধ্যাপক।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img