দেবতোষ চক্রবর্তী । ১৯৮৯-এ মাধ্যমিক পরীক্ষায় রাজ্যে পঞ্চম, ১৯৯১ -এর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় রাজ্যে সপ্তম, জয়েন্ট-এ মেডিকেলে ১৭। এরপরে ভর্তি হোলো কলকাতার এন আর এস মেডিকেল কলেজে। ১৯৯১ ব্যাচ ফার্স্ট ইয়ারের শেষ দিকে আমার রুমমেট হয়ে আসে দেবতোষ । স্টুডেন্ট হোস্টেলের পান্ডববর্জিত সাউথ গ্রাউন্ড ফ্লোর । ওর বাবা ছিলেন রাইটার্সের উচ্চপদস্থ অফিসার, মা সরকারি কলেজের অধ্যাপিকা। বাবা- মায়ের একমাত্র ছেলে দেবতোষ পৈতৃক সূত্রেই ছিলো বনেদি, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিলো ও । কিন্তু দেবতোষের চলনে বলনে বিত্তপ্রদর্শন বা অহং-এর লেশমাত্র ছিল না । পারিবারিক মূল্যবোধ ও নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের শিক্ষা ওর মধ্যে এক পরিপূর্ণ মানুষের ভিত গড়ে দিয়েছিল ।
আমাদের ব্যাচের নিঃসন্দেহে সেরা প্রতিভা দেবতোষ । কবিতা লেখা, নাটক তৈরি, অভিনয়, ব্যাডমিন্টন – সবার আগে দেবতোষ । একেক সকালে ঘুম ভেঙে দেখতাম , বড় ক্যানভাসে আঁকা অপূর্ব দৃশ্যপট, সারারাত ছবি এঁকে ঘুমিয়ে পড়েছে দেবতোষ । ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে রং,তুলি,প্যাস্টেল । আবার ,তুলনামূলকভাবে অল্পসময় পড়াশোনা করেই অসাধারণ রেজাল্ট করতো প্রতিটি পরীক্ষায়।
সঙ্গীত ছিল ওর প্যাশন, বলা ভালো দেবী সরস্বতীর মানসপুত্র ছিলো ও, সঙ্গীতের এমন কোনো রাগ নেই যা ওর অজানা, তেমনি ঈশ্বর প্রদত্ত গলা, আর ওর চেহারা ছবি দেখে মনে হয় স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। কি অসাধারণ কথাবার্তা, আমাদের সবাই ওর গুণে মুগ্ধ ছিলাম, কোনো গল্প শুরু হলে আমরা সবাই চাইতাম দেবতোষ যেন আরেকটু থাকে ।
এরপরে MBBS- এ অসাধারণ রেজাল্ট করবার পরে মেডিক্যাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার পরেই ও হোস্টেল ও কলেজ ছেড়ে চলে যায় দিল্লির AIMS -এ MD করতে। হার্ট-এর ওপর স্পেশালিস্ট MD হয়ে দেবতোষ পাড়ি দেয় মার্কিন মুলুকে হার্ট-এর ওপর গবেষণা করতে, দীর্ঘ কয়েকবছর হার্ট -এর ওপর গবেষণা করার পরে হঠাৎ-ই ও নিখোঁজ হয়ে যায়, দীর্ঘদিন কেউ ওর কোনো খোঁজ খবর পায় না । অনেক পরে খবর পাওয়া যায় যে, দেবতোষ সন্ন্যাস নিয়েছে। ২০০৮ – ০৯ নাগাদ কামারপুকুরে জয়ন্ত মহারাজের কাছে শুনি, দেবতোষ মহারাজ বেলুড় মঠের আরোগ্য ভবনের দায়িত্ব নিয়ে ফিরে এসেছেন ।
পরদিনই ছুটে যাই বেলুড়ে, প্রথম দেখাতেই আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই, কাকে দেখছি… মনে হচ্ছিলো স্বয়ং বিবেকানন্দ আমার সামনে। মুন্ডিতমস্তক,গেরুয়া বসন, চারিদিকে যেন জ্যোতি বেরোচ্ছে, সহপাঠী বন্ধুকে নিজের অজান্তেই পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে যেতেই একইরকম উষ্ণতা নিয়ে জড়িয়ে ধরে আমার বন্ধু দেবতোষ, না , ভুল বললাম … আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, স্বামী কৃপাকরানন্দ মহারাজ ।
বিখ্যাত ডাক্তার থেকে শুরু করে খ্যাতনামা সংগীত শিল্পী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অথবা কোনো নামী অভিনেতা ,যা ইচ্ছা হ’তে পারতো দেবতোষ…যা ইচ্ছা। কিন্তু সব ছেড়ে ও বেছে নিল অসীমের পথ…ত্যাগ, সেবা ।
থ্রি ইডিয়টসের র্যাঞ্চোকে মনে পড়ছে ? দেবতোষ মহারাজ , আমার সেই র্যাঞ্চো ।
—– দেবতোষ মহারাজের এক বন্ধু ।