বর্ণালী জানা
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একটা কথা নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে– ‘পোস্ট পার্টাম ব্লুজ’। সন্তান জন্মের পরে মায়েদের একরকম অবসাদ দেখা যায়, যখন তাদের ভীষণভাবে মুড সুইং করে, তারা নিজেদের সন্তানকেও সহ্য করতে পারে না। নিজেকে শেষ করে সঙ্গে সঙ্গে সদ্যোজাত সন্তানকেও মেরে ফেলার কথা তাদের মনে আসে। সন্তানটি তখন মায়ের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসকরা বলেন, ১০০ জন মহিলার মধ্যে ১৫ জন এ ধরনের প্রবণতার শিকার হন। সন্তান জন্মের জন্য শরীরে হরমোনের পরিবর্তনই এর জন্য দায়ী। কয়েক সপ্তাহ পরে সাধারণত এই অবসাদ চলে যায়। তবে কারও কারও মনে এই অবসাদের শিকড় অনেক গভীরে চলে যায়…তখন সেটা হয়ে যায় ঘোরতর ডিপ্রেসন…পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেসন। মোদ্দা কথাটা হল, মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্য। আমাদের সমাজে, পরিবারে মায়েদের স্বাস্থ্য ঠিক কতখানি গুরুত্ব পায়?… ‘এখানে মায়েদের স্বাস্থ্য একেবারে গৌণ বিষয়। কী শারীরিক, কী মানসিক’…আক্ষেপ করলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে যুক্ত মনোবিদ পম্পা মৈত্র চক্রবর্তী।
রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে মৃণাল তার স্বামীকে চিঠিতে লিখছে… ‘ ইংরেজ ডাক্তার এসে আমাদের অন্দর দেখে আশ্চর্য হয়েছিল এবং আঁতুড়ঘর দেখে বিরক্ত হয়ে বকাবকি করেছিল। সদরে তোমাদের একটুখানি বাগান আছে। ঘরে সাজসজ্জা-আসবাবের অভাব নেই। আর অন্দরটা যেন পশমের কাজের উলটো পিঠ; সেদিকে কোনও লজ্জা নেই, শ্রী নেই, সজ্জা নেই। সেখানে আলো মিট্ মিট্ করে জ্বলে, হাওয়া চোরের মতো প্রবেশ করে; উঠোনের আবর্জনা নড়তে চায় না’। মানে ঘরের সবচেয়ে অবহেলিত, নোংরা জায়গা হল, রান্নাঘর আর আঁতুড় ঘর। সেখানে প্রসূতি মারা যাবে, শিশু মৃত্যু হবে এতে আর আশ্চর্য কী! বিয়ে হবে, ভালোবাসা থাক না থাক, সন্তানও হবে। তাতে মায়ের স্বাস্থ্যের আর কতখানি গুরুত্ব!
এখন অবশ্য সময় বদলেছে। শিক্ষিত পরিবারগুলিতে মায়ের স্বাস্থ্যের অনেক যত্ন নেওয়া হয়। নিয়মিত চেক-আপ, ওষুধপত্র—কোনকিছুরই অভাব থাকে না। অনেক পুরুষই আজকাল স্ত্রীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাচ্চার দেখভাল করে, রাতে ন্যাপি পালটায় কিন্তু… ‘ এখনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাচ্চা মানে মায়ের দায়িত্ব’…জানালেন পম্পাদেবী। মায়ের মনে কী চলছে, মা নিজে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে কিনা, তা নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যাথা নেই। আর মায়ের মন খারাপ! সে তো নাকি বিলাসিতা। সমাজ ধরেই নিয়েছে, মা হওয়া মানেই একটা স্বর্গীয় অনুভূতি। সব মেয়েই মা হওয়ার জন্য ব্যাকুল। মা হওয়াতেই জীবনের পরিপূর্ণতা। এর কোনও অন্যথা হবে না। সে মেয়ে অন্যসব দিক থেকে সফল হতে পারে, কিন্তু মা না হলে তার নাকি জীবন বৃথা। তাই হাফ ডজন গ্র্যান্ডস্লাম জেতার পরও দেশের নামী সাংবাদিকের কাছ থেকে সানিয়া মির্জাকে শুনতে হয় ‘আপনি সেটল করবেন কবে?’ কিন্তু বিরাট কোহলির কাছে গিয়ে কারো বলার সাহস হবে ‘আপনি কবে বাবা হবেন?’ অথচ ঐশ্বর্য রাইয়ের দ্বিতীয়বার বেবি বাম্প দেখা দিল কিনা, বিয়ের এত বছর পরেও বিদ্যা বালান মা হলেন না কেন, সে নিয়ে মিডিয়াতে কত মুচমুচে আলোচনা। সমাজের সর্বস্তরে…মিডিয়ায়ে খুব সচেতন ভাবে মেয়েদের একটা স্টিরিওটাইপ তৈরি করা হয়েছে যে , তারা শুধু মায়ের জাত। মানে জীবনে যত এভারেস্টই তুমি ডিঙোও না কেন , মা না হলে সব বৃথা। বাবা হওয়াটা পুরুষের কাছে অপশন, কিন্তু মেয়েদের কাছে কম্পালশন। সন্তান ধারণের জন্য মায়ের মন প্রস্তুত কিনা, সে আরও একটু সময় চায় কিনা, তা কি কেউ কোনোদিনই জানতে চেয়েছে? আর গ্রামের যে মেয়েটা নিজের শরীর আর শারীরবৃত্তীয় সব প্রক্রিয়া জানার আগেই মা হয়ে বসল , তার মনে কতটা অনির্বচনীয় অনুভূতি পারে! তার শরীরটা শুধুমাত্র একটা যন্ত্র, যার ওপর তার নিজের কোনও অধিকার নেই। তার জরায়ু তো তার পরিবারের সম্পত্তি। সেখানে কখন সন্তান উৎপাদন হবে, কটা সন্তান হবে, সব নির্ধারণ করবে পরিবার। এমনকি সে গর্ভপাত করাতে পারবে না কিনা, সেটাও ঠিক করে দেবে রাষ্ট্রের আইন। আর যে মেয়ে যদি দেরি করে সন্তান ধারণ করতে চায়, বা একেবারেই চায় না, তাকে সমাজ বলবে বাঁজা…আরও কত কী। বিয়ের পর সন্তান না এলে , সব দোষ মেয়েটির…সেই বাঁজা। আবার বিয়ের পর গর্ভনিরোধের যাবতীয় দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে, তার শরীর যাবতীয় পিলের আস্তাকুঁড় হবে…সে তার যতই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাক না কেন। স্বাভাবিক উপায়ে সন্তান না এলে ,।যাবতীয় যন্ত্রণাদায়ক পরীক্ষা তার শরীরের ওপরই, যেভাবেই হোক বংশের মুখ তাকে রক্ষা করতে হবেই। আবার বেশি সন্তান যাতে না হয়, সেজন্য টিউবেকটমিটা তাকেই করাতে হবে। কিছুদিন আগে মহারাষ্ট্রের এক কৃষক পরিবারের কথা খবরে এসেছিল। সেখানে আট বার গর্ভপাতের পর ন-বারের বার মা হয়েছিলেন মহিলা। ডাক্তার বলেছিলে, মহিলা জীবনের প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়ে মা হয়েছিলেন। মাতৃত্বের এমনই মহিমা! প্রাণের যদি এতই ঝুঁকি থাকে , তাহলে ডাক্তাররা সেটা বোঝাননি কেন? যে প্রাণ এখনও পৃথিবীর আলো দেখেনি তার চেয়ে যে বেঁচে আছে তার প্রাণটা মূল্যবান নয়!
‘তার ওপর রয়েছে কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধ বোধ। সেজন্যও অনেক মা অবসাদের শিকার হন’…জানালেন পম্পাদেবী। আর যে মাকে পরিবারের চাপে গর্ভেই কন্যাসন্তানকে মেরে ফেলতে হয়, তার কষ্টটাও কি কেউ বোঝার চেষ্টা করে! … ‘এইভাবে পুত্র সন্তানের আশায় একের পর এক কন্যাসন্তানের জন্ম দিতে দিতে কুড়ি বছরে তিন-চারটি সন্তানের মা হয়ে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে কত মেয়ে আমাদের শরণাপন্ন হয়’…জানালেন পম্পাদেবী। নিজের কর্মজীবনে এমন অনেক কেস দেখেছেন তিনি। মেয়েদের, মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি যতদিন না গুরুত্ব পাবে , ততদিন মায়েরা এমনই অবসাদে ভুগবেন। কেউ চেপে রাখবেন, গুমরে গুমরে মরবেন। কেউ বা নিজেকে শেষ করে দেবেন। মা হওয়ার মধ্যে যদি শুধু যন্ত্রণাই থাকে, মুক্তি না থাকে তাহলে মা, সন্তান কেউই যে ভালো থাকবে না।