ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
খনার বচনে আছে, “চাল ভরা কুমড়ো লতা/লক্ষ্মী বলেন, আমি তথা।” এই প্রবাদ আমাদের দেখিয়ে দেয়, ধান্যলক্ষ্মী হয়ে উঠেছেন শাকম্ভরী-লক্ষ্মী। মার্কেণ্ডেয় পুরাণে আমরা শাকম্ভরী-দুর্গার স্তোত্র পাই, দেবী সেখানে নিজ দেহ থেকে শাকসব্জি ও ফলমূল হয়ে অজন্মার হাত থেকে মর্ত্যলোককে বাঁচাচ্ছেন ও পুষ্টিবর্ধন করছেন। পুষ্টি-বাগান রচনা ভারতবাসীর কাছে কেবল প্রয়োজন নয়, তা ধর্ম-সংস্কৃতির অঙ্গ।
কার্তিক পুজোর সময় যে শস্য-সরা রচনা করা হয়, তাতে বিবিধ খাদ্যশস্যের পাশাপাশি কচু ও সুশনি শাকের চারাও লাগানো হয়। এইভাবে ‘অ্যাডোনিস গার্ডেন’ ধারণা ধর্ম-সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে উদ্যান রচনা করতে শেখায়।
কবি কঙ্কণ চণ্ডীতে নিদয়ার সাধভক্ষণ অংশে নানান শাক রান্নার কথা আছে —
“আমার সাধের সীমা
হেলাঞ্চি কলমী গিমা
বোয়ালী কুটিয়া কর পাক।
ঘন কাটি খর জ্বালে
সাঁতলিবে কটূ তেলে
দিবে তাতে পলতার শাক।।
পুঁই-ডগা মুখী-কচু
তাহে ফুলবড়ি কিছু
আর দিবে মরিচের ঝাল।।”
এখানে হেলাঞ্চি বা হিঞ্চে শাক হল Enhydra fluctuans , Family : Asteraceae; কলমী Ipomea aquatica , Family: Convolvulaceae; গিমা Mollugo cerviana , Family: Aizozaceae; পুঁই Basella alba , Family: Basellaceae; কচু Colocasia esculenta , Family: Araceae; পলতা বা পটল শাক Trichosanthes dioica , Family: Curcurbitaceae.
কবি কঙ্কণ চণ্ডীতে ‘নিদয়ার মনের কথা’ অংশে রয়েছে —
“বাথুয়া ঠনঠন তেলের পাক
ডগি ডগি লাউ ছোলার শাক।।”
এখানে বেতো বা বাথুয়া Chenopodium album , Family: Chenopodiaceae; লাউ শাক Lagenaria siceraria , Family: Curcurbitaceae; ছোলার শাক Cicer arietinum , Family: Fabaceae.
ভূত চতুর্দশীতে( ভূত তাড়াতে) যে চৌদ্দ শাক আমরা খাই, তার মধ্যে আছে ওল, কেঁউ, বেতো বা বাথুয়া, কালকাসুন্দে, সরিষা, নিম, জয়ন্তী, শালিঞ্চ বা শাঞ্চে, গুড়ুচি বা গুলঞ্চ, পটুক বা পটল বা পলতা পাতা, শেলূকা Cordia dichotoma, হিলমোচিকা বা হিঞ্চে, ভন্টাকী বা ঘেঁটু বা ভাট এবং সুনিষণ্নক বা সুষুনি।
১৪ শাক হল, ওল, কেঁউ, বেতো, সর্ষে, কালকাসন্দি, নিম, জয়ন্তী, শালঞ্চী, হিঞ্চা, পটলপত্র (পলতা), শুলফা, গুড়িচী (গুলঞ্চ), ভণ্টাকী (ঘেঁটু), শুষনি) [সূত্র: রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্ব]
মানভূম অঞ্চলে জীহুড় দিনে (আশ্বিন সংক্রান্তি) ২১ রকমের শাক রান্না করে খাওয়ার বিধি আছে। এই শাকগুলির নাম — ওল, কেঁউ, বেতো, সরিষা, কালকাসুন্দা, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শোলফা, গুলঞ্চ, ভাঁট, সুষনি, কলমি, কুদ্রুং, কুলেখাড়া, থানকুনি, ব্রাহ্মী, বাসক এবং কালমেঘ।
বাংলার কুমারী মেয়েরা কার্তিক মাস জুড়ে নরকভয় নিবারণের জন্য যমপুকুর ব্রত উৎযাপন করতো। বাড়ির উঠোনে চৌকো পুকুর কেটে তার পাশে লাগাতো কলমি, শুষনি, হিংচে, কচু, হলুদ। পুতুল বসতো পুকুরের পশ্চিম পাড়ে — কাক, বক, হাঙর, কুমির আর কচ্ছপ। পুকুরে জল ঢেলে বলা হত ছড়া
“শুষনি-কলমি ল-ল করে
রাজার বেটা পক্ষী মারে…
কালো কচু, সাদা কচু ল-ল করে,
রাজার বেটা পক্ষী মারে।”
এই ব্রতের মাধ্যমে কুমারীদের শাক-সবজির বাগান তৈরিতে উৎসাহ জোগাতো। শাক নিয়ে নানান আচার, লোকবিশ্বাস, প্রবাদ, ধাঁধা, লোককথার মধ্যে বাংলার একটি বিশেষ সংস্কৃতি ফুটে উঠেছে। তা যে শাকের ভেষজ গুণের জন্যই বুঝতে বাকী থাকে না।
হিন্দুধর্ম মতে, মৃত্যুর পর আত্মারা প্রকৃতির মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। একে বলা পঞ্চভূত। ১৪ শাক খেয়ে ১৪ পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানানো হয়। ১৪ শাক ধোওয়ার পর বাড়ির প্রতিটি কোণে জল ছিটিয়ে দেওয়া হয়। ওল, কেঁউ. বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ. শুশনী, ভাঁটপাতা, পলতা পাতা দিয়ে শাক রান্না করা হয়।
পৃথিবী, জল, বায়ু, অগ্নি, আকাশ। এই হল পঞ্চভূত। আর মানবদেহ এই পঞ্চভূতের সমন্বয়েই তৈরি। মৃত্যুর পর দেহ আবার এই পঞ্চভূতেই মিলিয়ে যায়। আর ভূত চতুর্দশীতে পৃথিবী, জল, বায়ু, অগ্নি, আকাশ – এই পঞ্চভূতকেই সম্মান জানানো হয়।