২৭ জুন, শুক্রবার এই বছরের জগন্নাথদেবের রথযাত্রা হতে চলেছে। পুরীর মন্দির থেকে রথে করে মাসি গুণ্ডিচার বাড়ি যাত্রা করবেন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা। পুরীর মন্দিরে জগন্নাথ রূপে বিরাজ করছেন শ্রীকৃষ্ণ। সেখানে দাদা বলরাম এবং বোন সুভদ্রার সঙ্গে পূজিত হন জগন্নাথও।
মন্দিরের রূপ এখনকার জগন্নাথ মন্দিরটির সঙ্গে প্রথম তৈরি হওয়া পুরীর মন্দিরের অনেক পার্থক্য রয়েছে। শুধু মূল মন্দিরটা তৈরি করেছিলেন রাজা ইন্দ্রদুম্ন। পুরীর এই জগন্নাথ মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা রহস্য, যেগুলির আজও কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এক নজরে এমনই কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হল।
পুরীর মন্দিরের ছায়া মাটিতে পড়ে না: সূর্য আকাশে যে অবস্থানেই থাকুক না কেন, দিনের কোনও সময়েই জগন্নাথ মন্দিরের ছায়া মাটিতে পড়ে না। কোন প্রযুক্তিতে তৈরি হওয়ার ফলে এই সুউচ্চ মন্দিরের ছায়া মাটিতে পড়ে না, তা আজও বিস্ময়ের।
পুরীর মন্দিরের উপর দিয়ে কিছু ওড়ে না: কথিত আছে, মন্দিরের উপর দিয়ে কোনও পাখি ওড়ে না, বা মন্দিরের সামনে কোনও গাছের ডালেও পাখি বসে থাকতে দেখা যায় না। মন্দিরের উপর দিয়ে বিমান ওড়ে না। আর মন্দিরের গায়ে কখনই কোনও পাখিকে বসতে দেখা যায় না। এর কোনও যথার্থ ব্যাখ্যা মেলেনি।
পতাকা ওড়ে হাওয়ার বিপরীতে: জগন্নাথ মন্দিরের মাথায় থাকা পতাকা সবসময় হাওয়ার উল্টোদিকে ওড়ে। কোনও সুরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়াই ৪৫ তলা উঁচু বাড়ির সমান এই মন্দিরের চূড়ায় ওঠেন সেবায়েত। ১৮০০ বছরের পুরনো প্রথা মেনে প্রতিদিন মন্দিরের এক সেবায়েত মন্দিরের চূড়ায় উঠে এই পতাকা পরিবর্তন করে দেন। একদিনের জন্যেও এই প্রথার ব্যতিক্রম ঘটে না। বলা হয়ে থাকে, একদিনের জন্যও এই প্রথায় বাধা এলে, ১৮ বছর মন্দির বন্ধ রাখতে হবে।
পুরীর মন্দিরের মহাপ্রসাদ: দিনে পাঁচ বার মহাপ্রসাদ দেওয়া হয়ে থাকে জগন্নাথদেবকে। এর মধ্যে থাকে ৫৬ রকমের ভোগ। মহাপ্রসাদকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটি সুখিলা, অন্যটি শানখুডি। সুখিলাতে থাকে নানা ধরনের শুকনো মিষ্টি। আর শানখুড়িতে থাকে ভাত, ডাল, পোলাও অন্য রান্না করা খাবার। মন্দির চত্বরেই রয়েছে আনন্দবাজার। সেখানে এই প্রসাদ কিনতে পাওয়া যায়।
মহাপ্রসাদ তৈরির পদ্ধতি: মন্দিরের কয়েক হাজার সেবায়েত মিলে প্রতিদিন এই মহাপ্রসাদ প্রস্তুত করা হয়। সাতটি মাটির পাত্রকে একটির উপর আর একটি চাপিয়ে রান্না করা হয়। আগুন দেওয়া হয় একদম নীচে। আশ্চর্যের হল, সবার উপরে যে পাত্রটি থাকে, তার মধ্যের অন্ন সবার আগে সেদ্ধ হয়ে যায়। এই ভাবে পর পর সেদ্ধ হতে থাকে।
মন্দিরের প্রসাদ রহস্য: প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে দর্শন করতে আসেন। আর রথযাত্রা বা অন্য কোনও বিশেষ দিনে দর্শনার্থীদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু প্রতিদিন মন্দিরে একই পরিমাণ খাবার রান্না করা হয়। কিন্তু কখনও কোনও দিন জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদ বেশি হয় না, কমও হয় না। সব ভক্তরা প্রতিদিন প্রসাদ পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ প্রসাদে কখনও ঘাটতি দেখা যায় না।
পুরীর মন্দিরের শীর্ষের চক্র: মন্দিরের মাথায় রয়েছে প্রায় এক টন ওজনের একটি চাকা। বিস্ময়ের হল, পুরীর যে কোনও উঁচু জায়গা থেকে চক্রের দিকে তাকালে, সব সময়ই মনে হবে যে, চাকাটি আপনার দিকেই মুখ করে রয়েছে। আর দ্বাদশ শতকে নির্মিত এই মন্দিরে এতটা উঁচুতে কীভাবে একটা ভারী চাকা স্থাপন করা হল, তা এখনও রহস্য হয়ে রয়েছে।
জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার কাঠের মূর্তি: মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তিগুলি কাঠের তৈরি। প্রতি ৮, ১২ বা ১৯ বছর পর পর এই মূর্তি বদলানো হয়। একে নবকলেবর বলা হয়। পূর্ণবয়স্ক কোনও নিম গাছের মধ্যে শুভ লক্ষণ দেখে সেটিকে মূর্তি তৈরির জন্য চিহ্নিত করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মন্দিরের মুখ্য পুরোহিত স্বপ্নাদেশ পান যে গাছের কাঠ দিয়ে নবকলেবর হবে, তা কোথায় পাওয়া যাবে। সেই গাছের কিছু বিশেষত্ব থাকতে হবে। গাছটি নিমগাছ হবে কিন্তু তাতে চন্দনের গন্ধ থাকবে, গাছে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মর চিহ্ন থাকবে। সেই গাছে যেন কোনওদিন কোনও পাখি না বসে, পশু না চড়ে। আর গাছটি সাপেরা ঘিরে রাখবে।
গাছ চিহ্নিত করার পর গোপনীয়তা বজায় রেখে মূর্তি তৈরির কাজ ২১ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হয়। শেষবার জগন্নাথদেবের নবকলেবর হয়েছিল ২০১৫ সালে।
পুরীর মন্দিরে সমুদ্রের গর্জন শোনা যায় না: পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের অবস্থান সমুদ্রের কাছেই। কিন্তু আশ্চর্যের হল, এই মন্দিরের ভিতরে পা রাখলে সমুদ্রের গর্জন শোনা যায় না। সিংহদ্বারের মন্দিরে প্রবেশ করার পর প্রথম সিঁড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের আওয়াজ আর শুনতে পারবেন না। কিন্তু ওই সিঁড়িটি টপকে গেলে আবার সমুদ্রের শব্দ শুনতে পাবেন। সন্ধ্যাবেলায় এই বিষয়টি সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, সমুদ্রের গর্জনে ভিতরে শোনা গেলে, সুভদ্রার বিশ্রাম ভঙ্গ হত। তাই তাঁর অনুরোধেই মন্দিরের ভিতর সমুদ্রের গর্জন প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন জগন্নাথদেব।
সমুদ্রের উল্টো হাওয়া: সমুদ্র তীরবর্তী যে কোনও স্থানে সাধারণত দিনের বেলা সমুদ্র থেকে পাড়ের দিকে হাওয়া প্রবাহিত এবং রাতে পাড়ের দিক থেকে সমুদ্রের দিকে হাওয়া প্রবাহিত হয়। কিন্তু পুরীতে এটা উল্টো। পুরীতে দিনের বেলা পাড় থেকে সমুদ্রের দিকে হাওয়া প্রবাহিত হয় এবং রাতে সমুদ্র থেকে পাড়ের দিকে হাওয়া বয়।