সংযুক্তা সরকার
‘বাপি আর মা গেছে সিনেমা, তুমি একা
ভয় যদি হয়, আছে টিভিটাকে খুলে ভুলে থাকা।
মা গেছে বলে ওই টিভিটাকে খুলে তুমি রেখোনা
আমি বলি কী একটা চালাকি করে দেখো না
জানলা দিয়ে ওই আকাশটাকে দেখ।টিভি দেখো না.’
মনে পড়ে অঞ্জন দত্তের গানের লাইনগুলো? নাহ। জানলা, আকাশ তো নয়ই, আজকাল টিভিও ওরা দেখেনা।ওরা, অর্থাৎ আমাদের ছয় থেকে ষোলর দল।ইউটিউবে ভিডিও দেখে ঘন্টার পর ঘন্টা, নেটফ্লিক্সে পছন্দের শো-এর একের পর এক এপিসোড চলতে থাকে। অথচ টিভি দেখার উৎসাহে ভাঁটা।নিজের মতো করে নিজের নিজের ব্যক্তিগত কোণে মোবাইল ফোন, ট্যাব, আই-প্যাড অথবা ল্যাপটপ নিয়ে বড়োদের মতোই একা হয়ে যাচ্ছে ওরা এক একজন। বোকা বাক্সের সামনে সপরিবারে বসে বোকা হওয়ার দিন আর নেই।
অথচ দু-এক দশক আগেও ছবিটা ছিল অন্যরকম।মায়ের ‘টিভি দেখো না’র চোখরাঙানি সত্বেও, গৃহ শিক্ষক অঙ্ক কষতে দিয়ে বসে থাকা সত্বেও, জল খাওয়া, পেটে ব্যাথা ইত্যাদি নানা অজুহাতে টিভির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ার স্মৃতি নেই এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর।শনিবারের একটিমাত্র সাপ্তাহিক হিন্দি ছবি, রবিবারের বাংলা, ‘চিত্রহার’, ‘চিত্রমালা’, ‘দর্শকের দরবারে’, ‘চন্দ্রকান্তা’ আর ‘নুক্কড়ের’ টানে হা করে অপেক্ষা করে থাকা, ঘন ঘন ঘড়ি দেখা কোনোটাই বাদ ছিল না সেদিন।কেবল চ্যানেলের রমরমা ছিল না। মহালয়ার সকালে আলাদা আলাদা চ্যানেলে আলাদা আলাদা দুর্গা ছিল না। একা দূরদর্শন-ই সেদিন দূর-অদূরের ছবি এনে দিতো সাজানো ড্রয়িং রুমের চেনা অন্দরে। আর সেখানেই হাসি-রাগ-অভিমান-ঝগড়া-আপোষের পাশাপাশি দাদু-দিদা-মা-বাবা-ভাই-বোনের সঙ্গে একসঙ্গে বসে চলতো টিভি দেখা।সেটা যে সবসময় খুব সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল তা নয়, না চাইলেও অনেক কিছু দেখতে হতো অনিচ্ছাতেও। তবে সপরিবারে টিভি দেখতে গিয়ে পারিবারিক আদান প্রদানটুকু হতো। যা আজ ইতিহাস। উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখে ঠাকুমার সমানে আঁচল দিয়ে চোখ মোছা আড়চোখে দেখে ফেলা অথবা ওয়ান ডে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে বসে সবাই মিলে একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা, রামায়ণ-মহাভারতের সময় টেলিভিশনের সামনে বাড়ির ছোটটার গদা আর তীর ধনুক নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, পারিবারিক টিভি দেখার সেসব দৃশ্য আজ বিরল।ড্রয়ইংরূমের গমগমে টিভির আওয়াজ ওদের না-পসন্দ।হেডফোন কানে চেপে বাইরের দুনিয়া থেকে মুখ সরিয়ে ল্যাপটপ, মোবাইল নিয়ে নিজেদের ঘরে ওদের জগৎটাকে নিজেদের মতো করে ওরা গুছিয়ে নিতে চায়। একই বাড়িতে থেকেও নিজের ছোট্ট গন্ডীর বাইরে পুরোটাই আজ বহির্জগৎ।
আজকের এইসব ইউটিউব কিডসদের কাছে আমি, আমার মন, আর আমার গ্যাজেট, ছোট্ট সংগঠন। সুতরাং সপরিবারে টিভি দেখা আজ বন্ধ। এই প্রজন্ম যে পছন্দের অনুষ্ঠান, ছবি, ভিডিও দেখছে না, তা নয়। দেখছে।বরং অনেক বেশি সময় ধরে দেখছে। ব্যক্তিগত পরিসরে।মোবাইল বা ল্যাপটপের পর্দায়।টিভির পর্দায় নয়। নেটফ্লিক্সে তাদের পছন্দের টিভি শো-এর একটার পর একটা পর্ব দেখে চলেছে তারা। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে চলছে বিঞ্জ ভিউইং। শিশু গবেষকদের মতে, এই প্রজন্মের কিশোর কিশোরীদের অর্ধেকের বেশি একই অনুষ্ঠানের একটার পর একটা এপিসোড দেখে যেতেই পছন্দ করছে।সারাদিনে তারা যদি আড়াই ঘন্টা দেখে, সেক্ষেত্রে হয়তো পুরো সময়টা ধরেই একটা শো দেখছে। কাঙ্খিত পর্বের জন্য সেই যে অপেক্ষা করে থাকা, সেই যে মনের মধ্যে চলতে থাকা ‘কী হয়-কী হয়’ ভাব গোটা একটা সপ্তাহ ধরে জমিয়ে রাখা উৎকণ্ঠা, ঔৎসুক্য সে সবই টু ইন ওয়ান টেপ রেকর্ডার, ক্যাসেট বা পুরোনো ভি এইচ এস রেকর্ডারের মতোই ওদের জীবনে মিসিং।
পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে টিভি দেখার আরেকটা দিক ছিল যে কোনও অনুষ্ঠান নিয়ে খাওয়ার টেবিলে বা চায়ের আসরে আলোচনার ঝড়, তুমুল তর্ক, বাকবিতন্ডা।এই সবই ছিল পারিবারিক আদান প্রদানের অঙ্গ।তর্ক, আলোচনা তো দূরের কথা বাড়ির কিশোর কিশোরীর সঙ্গে এই ধরণের কথোপকথন ও আজ বিরল। স্বাভাবিকভাবেই ঢুকে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়া এবং তাতেও শুধু নিজের স্বছন্দের বিষয় নিয়েই আলোচনা। যা আমার পছন্দের নয়, যাতে আমার ভিন্নমত হতে পারে তা আমি দেখবোই না। জানবোও না। ‘টিভি দেখোনা’র সেদিনের সেসব কঠোর নিষেধাজ্ঞা তো দূরস্ত, সন্তানের হাতের মুঠোয় ধরা ফোন বা কোলে রাখা ল্যাপিতে কী কী ঘটনা ঘটে চলেছে তার খোঁজ রাখা আজকের অভিভাবকদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। বোকা বাক্সের সঙ্গে সখ্যতা নেই বর্তমান কৈশোরের, তাই হয়তো মা-বাপিকে বোকা করে দিয়ে ওদের ক্রমশ আরও ছোট হয়ে আসা পরিসরে সহজেই ঢুকে পড়ে ব্লু হোয়েল, ফায়ার ফেয়ারি, মোমোরা।