মহুয়া ভট্টাচার্য, সাংবাদিক ও চিত্রশিল্পী
বাড়িতে মডেল এনে ন্যুড স্টাডি ? আর্টিস্ট? তাও আবার মহিলা আর্টিস্ট? হোক না বিদেশ ফেরত। নগ্ন নারীদেহ এঁকে বিশ্ববিখ্যাত ? তাতেই বা কি? রক্ষণশীল হিন্দু বাড়িতে এসব কি স্বেচ্ছাচারিতা?
এটা তো শিল্পের একটা অঙ্গ। সমাজ অনুমতি না দিলেই বা কি! বাড়িতেই শুরু হল অভিযান। বাড়িতে মডেল এনে নগ্ন নারী দেহের ছবি আঁকছেন শিল্পী করুণা সাহা। শুধু নিজেই কাজ করেই ক্ষান্ত নন। শিল্পীদেরও অনুপ্রাণিত করছেন।
১৯৬০ সাল। শিল্প ভাবনা নিয়ে তখন ঝড় উঠেছে সমাজে। দল গড়তে হবে। শিল্প প্রকাশ নিয়ে বৈপ্লবিক ভাবনা। মুষ্টিমেয় হলেও বেশ কয়েকজন নারী স্কলারশিপ নিয়ে পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষিত হতে বিদেশ গেলেন। ফিরে এসে তাঁরা তখন নিজ নিজ ধারায় স্বপ্রতিষ্ঠ। কিন্তু পুরুষ সমাজে তাঁরা ব্রাত্য। করুনা সাহা, শানু লাহিড়ী সন্তোষ রোহতগী, মীরা মুখোপাধ্যায় ও শ্যামশ্রী বসু, কেউ ফ্রান্স, কেউ ইতালী, কেউ সিডনি, কেউ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে এসে শিল্প সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে এসেছেন, কেউ জার্মান থেকে ভাষ্কর শিল্প নিয়ে পড়াশোনা করে এসেছেন। ছোট ছোট লাইনে কেউ সমাজকে কটাক্ষ করেছেন, কেউ দৈনন্দিন জীবন ধারাকে তুলে ধরেছেন। কেউ প্রকৃতির অবক্ষয়কে বিমূর্ত শিল্পে তুলে ধরেছেন, আর মীরা মুখার্জির ভাস্কর শিল্প তো ফ্রোজেন মিউজিক। তাঁর বড় বড় বুদ্ধ মূর্তি ভুলবার নয়।
১৯৮৩ সাল।শানু লাহিড়ীর বাড়ি ল্যান্সডাউনকোর্টে। সেখানে উপস্থিত করুণা সাহা, সন্তোষ রোহতগী, মীরা মুখার্জি, ও শ্যামশ্রী বসু। করুণা সাহা কথাটা তুললেন। একটা নারী শিল্পী দল গড়ে তুলতে হবে। সবাই সমস্বরে একমত। যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। গড়ে উঠল “দ্যা গ্রুপ” প্রথম নারী শিল্পী গোষ্ঠী। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো এই পাঁচজন শিল্পীর নামকরণ করল পঞ্চকন্যা ।
মেয়েরা শুধু সূচিশিল্পেই আবদ্ধ থাকবে কেন? চিত্রশিল্প, ভাস্কর শিল্পেও তাঁদের বিকাশ চাই। এটা হবে মেয়েদের আত্মপ্রতিষ্ঠার হাতিয়ার। অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই কেউ এই দলের সদস্য হল, কেউ অতিথিশিল্পী। দলের প্রথম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ। সেদিনের সেই অনুষ্ঠান ছিল নানান শিল্প ধারার মিলনের সঙ্গমস্থল। নৃত্যশিল্পী রানি কর্নার, সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী, সাংবাদিক আরুণি মুখার্জি, ইতিহাসের অধ্যাপিকা রত্নাবলী চ্যাটার্জি, ভাস্কর শিল্পী স্বনামধন্য উমা সিদ্ধান্তও এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আরও অনেকেই ছিলেন সেদিনের বিশিষ্ট অতিথি। সেদিন ছিল যেন নারী শিল্পের জাগরণ। সেদিন ছিল “দ্য গ্রুপ” পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের একমাত্র নারী শিল্পী গোষ্ঠী। আজও তারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ৩৬ বছর ধরে এই দল কাজ করে যাচ্ছে অপ্রতিহতভাবে।
এই পঞ্চকন্যার চারজন শিল্পী আজ প্রয়াত।শ্যামশ্রী বসু আশি উর্ত্তীণা। কিন্তু আজও তিনি অপ্রতিহতভাবে তাঁর শিল্পসৃষ্টির কাজ অব্যাহত রেখেছেন। শুধু তাই নয়, অনুপ্রাণিত করে চলেছেন ১৫ জন সদস্যকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাঁরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ।এই দলের সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত আছেন অঞ্জলি সেনগুপ্ত। তিনি একজন শিক্ষাবিদ। লোকশিল্প নিয়ে তার পড়াশোনা।তিনি লোকশিল্পকে ভিত্তি করে ছবি এঁকে যাচ্ছেন। এই প্রতিবেদক এই দলেরই সদস্য। ক্যানভাসে কাব্যিক পরিমণ্ডল তৈরি করা, উজ্জ্বল বিন্দু দিয়ে জমাট বুনটে পট বিভাজন ও বর্ণময় স্বপ্নের প্রকৃতি গড়ে তোলাই তাঁর বৈশিষ্ট্য।সীমা ঘোষ ভট্টাচার্যের বৈশিষ্ট্য জীবনের সদর্থক ভাবনার অনুসন্ধান করা । তাই তাঁর কাজে রয়েছে আলো-আঁধারের রহস্যময়তা। রিনা মুস্তাফি মূলত তেল রঙে স্প্যাচুলা দিয়ে বিশেষ টেকনিকে প্রকৃতিকে খোঁজার চেষ্টা করেন। মিনতি নাথ বাস্তব-ঘেঁষা নারীর ছবি আঁকেন।তমালি দাশগুপ্ত বিক্ষুব্ধ পৃথিবীকে তুলে ধরেন বিমুর্ত শিল্পের মাধ্যমে।আরতি দাস ভারতীয় শিল্পধারার ছবি আঁকেন। মধুশ্রী মুচ্ছল ইন্দোরে থাকলেও এই দলে আছেন ও প্রদর্শনীতে নিয়মিত ছবি পাঠান। তিনিও আঁকেন বিমুর্ত শিল্প। মৈত্রেয়ী চ্যাটার্জি সন্ধান দেন অন্য এক ভুবনের। যেখানে আছে রাগ রাগিনীর সমাহার। ভারতী চৌধুরী আমেরিকায় থাকলেও এই দলে আছেন ও প্রদর্শনীতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন তিনি। প্রিন্ট ও মনোপ্রিন্টে কাজ করেন।সান্ত্বনা দত্ত বিমূর্ত শিল্পে কাজ করেন অভিনব ভাবনা নিয়ে। তিনি মনে করেন কিছুই স্থিতিশীল নয়। সবই ঘূর্ণায়মান। তাই তাঁর ছবিতে সেটিই প্রকাশ পায় । সুদেষ্ণা দাসও এই দলের একজন উল্লেখযোগ্য শিল্পী। তাঁর কাজেও অভিনবত্ব রয়েছে। এছাড়া রয়েছেন দুইজন ভাস্কর শিল্পী।নীলিমা গোয়েল যে কোনও বস্তুকে শিল্পের মাধ্যম করে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। আর বনশ্রী খানের ভাস্কর্য জীবনের অন্য এক অনুসন্ধানের খোঁজ দেয়। তার কাজের মাধ্যম হল ধাতু।
২০১৯-এর ১৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হলো দা গ্রুপের ৩৬তম বার্ষিক প্রদর্শনী অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে। ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আজও স্বমহিমায় প্রজ্জ্বলিত। সবাই নিজেদের শিল্পচর্চার সাক্ষর রাখতে পেরেছে। শুধু তাই নয় মৌলিকতা ও স্বতন্ত্রও প্রমাণ করতে পেরেছে। “দ্য গ্রুপ” ভারতের সর্বত্র বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনী করে যাচ্ছে। সরকারি অনুদান কিংবা শিল্প সংস্থার সহায়তা পেলে এই একমাত্র মহিলা শিল্পী গোষ্ঠী তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে সমর্থ হবে।