হোমক্রাইম রিপোর্টারCRIME REPORTER : বাংলার প্রথম সিরিয়াল কিলার, ৩ মাসে খুন ৬ মহিলা

CRIME REPORTER : বাংলার প্রথম সিরিয়াল কিলার, ৩ মাসে খুন ৬ মহিলা

CRIME REPORTER : বাংলার প্রথম সিরিয়াল কিলার, ৩ মাসে খুন ৬ মহিলা

(CRIME REPORTER : এই পর্বে শোনানো হবে নানান অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী। বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর -এর কলমে।)

হীরক কর : সিরিয়াল কিলার পশ্চিমবঙ্গে। বাইশে শ্রাবণ সিনেমায় বাঙালি সিরিয়াল কিলার দেখিয়েছিলেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। পরিচালক সুজয় ঘোষের হিন্দি ছবি কাহানীতেও দেখা গিয়েছিল বাঙালি সিরিয়াল কিলার। সেসব ছিল নিছকই কল্পনা। কিন্তু বাস্তবের মাটিতেও দেখা মিলছে  বাঙালি সিরিয়াল কিলারের। যার টার্গেট কেবল মহিলারাই!

২০১৯-এর ২ জানুয়ারি কালনার উপলতি গ্রামে মিটার রিডিং দেখার নাম করে বাড়িতে ঢুকে লক্ষ্মীবালা পাল নামে এক  বৃদ্ধাকে গলায় শেকল পেঁচিয়ে খুনের চেষ্টা করে কামরুজ্জামান। এরপর মেমারীর সেগুনবাগানের বাসিন্দা মমতা কিস্কুকে (৫০) এবং বড়া গ্রামের বাসিন্দা রীতা রায় (৫২) নামে দুই মহিলাকে খুন করে সে। একইভাবে কালনার আনুখালা গ্রামে খুন হন পুষ্প দাস নামে এক বৃদ্ধা। ওই বছরই  ৩১ মার্চ কালনা থানার হাটকালনা গ্রাম পঞ্চায়েতের ধর্মডাঙা গ্রামে ইতি মণ্ডল নামে এক গৃহবধূকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার চেষ্টা চালায় সে। সর্বশেষ তার শিকার সিঙ্গারকোণের বাসিন্দা স্থানীয় বাদলা হাইস্কুলের দশম শ্রেণির এক ছাত্রী। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি  করা হয় । এইভাবেই সে ২০১৯-এ ৩ মাসে ৬ জন মহিলাকে খুন এবং বেশ কয়েকজন মহিলাকে খুনের চেষ্টা করেছে সে। 

নিজেকে বিদ্যুৎ দফতরের মিটার রিডার হিসেবে পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি ব্যবসাও করত সে । কামরুজ্জামান একাকী মহিলাদেরকেই নিশানা করত। প্রথমে বার কয়েক সেই জায়গায় রেইকি করত। তারপর সুযোগ বুঝে মিটার দেখার নাম করে ঢুকে পড়ে প্রথমে চেন দিয়ে গলায় পেঁচিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করত। মৃত্যু নিশ্চিত করতে লোহার রড দিয়ে আঘাত করত। তারপরই হাতের কাছে যা কিছু মিলত, তা নিয়ে পালাত। এভাবেই তার হাতে মৃত্যু হয়েছে ৬ জন মহিলার। আহত হয়েছেন ৩জন।

মহিলাদের প্রতি তার ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা। আর তার জেরেই সে করে গিয়েছে একের পর এক খুন। নেপথ্যে ছিল প্রেম। প্রথমে প্রেমের প্রস্তাব। তারপর বেশ কিছুদিন প্রেম। তারপর প্রেমিকাকে খুন। আপাতত সিনেমার চিত্রনাট্য বলে মনে হলেও আসলে এটা বাস্তব ঘটনা।

খুনের আগে ও পরে  যৌন নির্যাতন চালানো হত বলে তদন্তে জানতে পারে বর্ধমান জেলা পুলিশ । মাথায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করে চেন দিয়ে আটকে রাখা হত। হাত থেকে চেন যাতে পিছলে না যায়, সে জন্য লাগানো থাকত  রবারের টিউব। গ্রেফতারের পর কালনা থানায় জেরা পর্বে উপস্থিত ছিলেন  মন্তেশ্বর, মেমারি, পাণ্ডুয়া-সহ পাঁচ থানার ওসি। যাঁরা হামলায় বেঁচে গিয়েছিলেন শনাক্তকরণের জন্য আনা হয়েছিল তাঁদের এক জনকেও।

২০১৯-এর শুরুর ৩ মাস ধরে কুখ্যাত এই সিরিয়াল কিলারকেই খুঁজে চলেছিল পূর্ব বর্ধমানের  পুলিশ। বর্ধমান রেঞ্জের পুলিশ  কামরুজ্জামানের খোঁজে রীতিমতো তৎপরতা দেখায়। তদন্তে নামার আগে পুলিশের  কাছে খবর আসতে থাকে এলাকা জুড়ে একের পর এক খুন হচ্ছে। খুনের চরিত্র মিলিয়ে দেখা যায়, প্রত্যেকটি খুনের নিশানা কোনও না কোনও মহিলা। তদন্তে নেমে  উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

মুর্শিদাবাদ থেকে এসে কালনায় থাকতে শুরু করেছিল কামরুজ্জামান সরকার । পেশা বলতে ছিল ভাঙের ব্যবসা। মোটরবাইক পছন্দ করত। তবে মহিলাদের বেছে বেছে কেন খুন? তদন্তকারী অফিসারদের মতে, মহিলাদের ওপর কোনও সুপ্ত ঘৃণার জেরেই একের পর এক খুন করে গিয়েছিল কামরুজ্জামান। প্রতিটি খুনই সে গলায় সোনার চেনের ফাঁস দিয়ে ঘটিয়েছে। আর খুনের পর মহিলাদের মূল্যবান কিছু জিনিস লুঠ করে পালাত। অভিযোগ, খুনের পর মৃতদেহের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়াত কামরুজ্জামান। জয়ের স্মারক হিসেবে কিছু জিনিস  বাড়িতে রেখে দিত সে। এটাকে মানসিক রোগ বলে মনে করছেন মনোবিদরা । তার দেখানো জায়গা থেকেই উদ্ধার হয়েছে প্রচুর পরিমাণে সোনা, রুপো এবং ইমিটেশনের গয়না। উদ্ধার হয়েছে খুনে ব্যবহৃত সোনার চেনটিও।

কামরুজ্জামানের আদি বাড়ি মুর্শিদাবাদ। তবে বছর পনেরো ধরে পূর্বস্থলী ১ নম্বর  ব্লকের গোয়ালপাড়ার কাছে সুজননগরে থাকত সে। ওখানেই শ্বশুরবাড়ি। বছর দেড়েক আগে এলাকায় জমি কিনে বাড়িও করেছে। বাড়িতে বাবা-মা, স্ত্রী, ভাই-বোন, তিন ছেলেমেয়ে রয়েছে। গ্রেফতারের দিনও পড়ন্ত বিকেলে কোথাও অঘটন ঘটাতে যাচ্ছিল সে। সঙ্গে থাকা ব্যাগে পাওয়া গিয়েছিল লোহার শাবল, লোহার চেন। চেনের দু’প্রান্তে বাঁধা ছিল রবার টিউব। গোড়ার দিকে দু’একটি ঘটনায় লোহার চেন ঘটনাস্থলেই ফেলে আসছিল কামরুজ্জামান। তবে মাস দুয়েক আগে মেমারির বরা ও সাতগেছিয়ায় বাড়িতে একা থাকা দুই মহিলা খুন হন। তাঁদের মাথায় আঘাতের চিহ্ন পায় পুলিশ। তার পর থেকে সব ঘটনাতেই ‘শিকার’-এর মাথায় চোটের চিহ্ন  মিলেছে।

আপাতভাবে শান্ত কামারুজ্জামান কীভাবে এমন একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটাতে পারে তা নিয়ে হতবাক এলাকাবাসী। কামরুজ্জামানের প্রতিবেশীদের দাবি, সব সময়েই জামা-প্যান্ট গুঁজে পরত সে। হাতে ঘড়ি, দামি সিগারেট, পালিশ করা জুতো পরত। তবে কী কাজ করত তা জানতেন না কেউ। তাকে শুধু সেজেগুজে মোটরবাইক নিয়ে সকালে বেরিয়ে যেতে দেখতেন এলাকার  বাসিন্দারা। মাঝেমধ্যে সমুদ্রগড় স্টেশন লাগোয়া বাজার এলাকায় আড্ডা মারতে দেখা যেত।

কামারুজ্জামানের দাদা আনারুল ইসলাম জানিয়েছেন, ১৫ বছর আগে বড়োয়া থানার পাঁচথুপি এলাকার এক মহিলাকে সে বিয়ে করেছিল। যদিও সেই মহিলা মাত্র একমাস থাকার পর বাপের বাড়ি চলে যায়৷ ভাইয়ের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়ে দেন তিনি৷

পুলিশের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে ধোপদুরস্ত জামা কাপড়ের পাশাপাশি হেলমেট পরে ঘুরে বেড়াত কামরুজ্জমান। সেটা আঁচ করতে পেরেই কালনা পুলিশ ব্যাপক  নাকা চেকিং শুরু করে। আর ২০১৯-এর ৩ জুন, রবিবার রাতে নাকা চেকিংয়ের সময়ই ধরা পড়ে যায় এই খুনি। ধোপদুরস্ত পোশাক, মাথায় হেলমেট দেখে সন্দেহের জায়গা ছিল না। কিন্তু হিসেব বদলে দেয়  সিসিটিভি ফুটেজের ছবিটা!

গুঁজে পরা সাদা চেক শার্ট-প্যান্ট, পালিশ করা কালো জুতো, ঘড়ি, লাল হেলমেট, লাল বাইক, তাতে ঝোলানো নাইলনের ব্যাগ, সবটাই হুবহু মিলে গিয়েছিল। তাতেই ধরা পড়ে যায়  কালনা, মেমারি, মন্তেশ্বর, পাণ্ডুয়ায় বাড়িতে একা থাকা পাঁচ মহিলাকে খুন, ১৫ মহিলাকে খুনের চেষ্টায় অভিযুক্ত যুবক। কালনার সাধপুকুরের কাছে ওই যুবককে ধরে ফেলেন এক সিভিক পুলিশ। সঙ্গে সঙ্গে বুলবুলিতলা ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানে কিছুক্ষণ জেরা করার পরে আনা হয় কালনা থানায়। পুলিশের দাবি, ধৃত কামরুজ্জামান সরকার জেরায় স্বীকার করে, সে-ই খুন করেছে একের পর এক মহিলাকে। তবে কেন ? তা এখনও জানতে পারে নি কেউ ।

2020-র ছয় জুলাই তাকে ফাঁসির সাজা  শোনায় কালনা আদালত । কিন্তু সেই সাজা মুকুব করার জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করে সে। সে মামলা এখনও চলছে ।

২০১৩ সালে খুনে হাতেখড়ি ‘সিরিয়াল কিলার’ কামরুজ্জামান সরকারের। কালনায় বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে দেনায় ডুবে গিয়েছিল। দেনা শোধ করতে না পেরেই চুরির রাস্তা বেছে নেয় শেষ পর্যন্ত। তবে চুরি করতে গিয়ে দু’বার ধরাও পড়ে সে। একবার তাকে গণধোলাইও দেওয়া হয়। এছাড়া চুরির অপরাধে একবার জেলও খেটেছে কামরুজ্জামান।

বলাগড়ে চুরির পর ধরা পড়ে কামরুজ্জামান। সেবার তাকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। অন্যদিকে, মুর্শিদাবাদে চুরির ঘটনায় কামরুজ্জামানকে জেল খাটতে হয়। এরপরই সে চুরির কৌশল বদলে ফেলে। রীতিমতো ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করেই চুরির ছক সাজায় সে। এই সময়ই কামরুজ্জামানের টার্গেট হন একাকী মহিলারা। দীর্ঘদিন ভাঙাচোরা জিনিসের ব্যবসা করায় কামরুজ্জামান ভালভাবেই জানত, কোন এলাকায়, কোন বাড়িতে মহিলারা একা থাকেন। আর সেই মতো সেসব বাড়িতে চড়াও হতো  সে। তবে ধরা পড়ার ভয়ে বড় বাড়িতে চুরির ছক কষত না।

২০১৩ সালে প্রথম খুন করে কামরুজ্জামান। এরপর দ্বিতীয় খুন করে ২০১৮ সালে। এই ৫ বছরে তার গতিবিধি খতিয়ে দেখে  পুলিশ। চুরি করতে গিয়েই খুনের নেশা চেপে বসে কামরুজ্জামানের। তারপরই পরপর খুন করতে থাকে সে। এখান থেকেই তার মধ্যে জন্ম নেয় বিকৃত মানসিকতা। যার ফলস্বরূপ খুনের পর মৃতদের সঙ্গে যৌনাচার করত বছর পঁয়ত্রিশের কামরুজ্জামান। চুরি করতে করতেই খুনের নেশা চাপে তার মাথায়। সেই থেকেই কামরুজ্জামান হয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গের প্রথম  ‘সিরিয়াল কিলার’।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img