হোমদেশEditorial: বিজেপি-বিরোধী জোট, সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে কংগ্রেসকেই

Editorial: বিজেপি-বিরোধী জোট, সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে কংগ্রেসকেই

Editorial: বিজেপি-বিরোধী জোট, সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে কংগ্রেসকেই

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) চান, ভারত হোক বারবার কংগ্রেস-মুক্ত। ইদানিং কংগ্রেস (Congress) নেতাদের একাংশ গান্ধী পরিবারকে নেতৃত্ব থাকে সরানোর দাবিতে সরব হয়েছেন। রাজনীতিক মহলেও এই নিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়েছে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক কাঠামোকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গেরুয়া শিবির। আশ্চর্যের হল, কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ শিবিরের নেতারা দেশের এই কঠিন পরিস্থিতিতে বিজেপির বিপজ্জনক রাজনীতি নিয়ে খুব একটা মুখ খুলছেন না। তার চেয়ে তাঁদের বেশি নিশানা করছেন সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধীকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে ভাষায় পরিবারতন্ত্র নিয়ে কংগ্রেসকে খোঁচা দেন, অনেকটা একই সুর শোনা যাচ্ছে কপিল সিব্বল, গুলাম নবি আজাদের মতো নেতাদের মুখে।

অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত কংগ্রেসের হাতে এই মুহূর্তে কোনও কর্মসূচি নেই। নির্বাচনের সময় রাহুল-সোনিয়াকে সামনে রেখেই ভোটারদের দ্বারস্থ হন কংগ্রেস প্রার্থীরা। জরুরি অবস্থার পর নিজের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় কাটিয়ে ১৯৮০তে ক্ষমতায় ফিরেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তবে স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেসের লাগাম বরাবরই ছিল গান্ধী-নেহরু পরিবারের। ১৯৯১-এ রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর রাজনীতি থেকে নিজেকে পুরোপুরি সরিয়ে নিয়েছিলেন সোনিয়া। ১৯৯৮-এ এক টালমাটাল পরিস্থিতিতে তিনি কংগ্রেসের হাল ধরেছিলেন। তারপর থেকে পরপর দুবার কেন্দ্রে সরকার গড়েছে কংগ্রেস। সোনিয়ার নেতৃত্ব নিয়ে ইতিপূর্বে কখনও প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু পুত্র রাহুলকে সভাপতি পদে বসানো এবং একের পর এক নির্বাচনে কংগ্রেসের ব্যর্থতার জেরে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছেন দলের বিক্ষুব্ধ শিবিরের নেতারা। লক্ষ্য একটাই, গান্ধী পরিবারের হাত থেকে কংগ্রেসকে মুক্ত করা।

একটা কথা মনে রাখা দরকার, একসময় মহাত্মা গান্ধী বা জহরলাল নেহেরুকে সামনে রেখে ভোট চাইলে, ভোটারদের মধ্যে তার একটা প্রভাব লক্ষ্য করা যেত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বদলেছে মানুষের ভাবনা। বর্তমান প্রজন্মের অতীত নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। তাই অতীতে পারিবারিক প্রতিপত্তি, ঐতিহ্য, গরিমা, যাই থাক না কেন, এখনকার প্রজন্ম তাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না।

২০১৪তে গোটা উত্তর ভারতের বিপুল অংশের মানুষের সমর্থন পেয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তখন মোদিকে ঘিরে তাঁরা নতুন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ভেবেছিলেন তিনি দেশকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। কিন্তু মোদি পারেননি। বলা যায়, তিনি চরমভাবে ব্যর্থ। তবুও ২০১৯-এ তিনি আবার জিতলেন। কারণ, মোদির বিকল্প কোনও নেতা দেশবাসীর সামনে তুলতে ধরতে পারেননি বিরোধীরা। তারপর থেকে তিনটি বছর কেটে গিয়েছে। ২ বছর পর আবার লোকসভার ভোট। এখনও পর্যন্ত বিরোধী শিবিরে কোনও সুসংহত চেহারা দেখা যাচ্ছে না। এভাবে চললে, ২০২৪-এর নির্বাচনেও অনায়াসে জিতবেন মোদি। সেক্ষেত্রে, যেটা ঘটবে, তা হল, ২০২৯-এর মধ্যে ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে যাবে। নানা ধর্ম ও জাতির দেশ ভারতে জোরদার হবে হিন্দুত্ববাদের থাবা। ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। এটা আশঙ্কা নয়, বাস্তবে তা-ই ঘটতে চলেছে। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেই লক্ষ্যেই কাজ করে চলেছেন মোদি, অমিত শাহরা।

২০১৪তে ক্ষমতায় পরপরই যোজনা কমিশনের অবলুপ্তি ঘটিয়েছিলেন মোদি। বদলে গঠন করেছিলেন নীতি আয়োগ। কিন্তু যোজনা ভবনের পরিবর্তন হয়নি। একটাই পরিবর্তন হয়েছে। তা হল, গত ৬৫ বছর ধরে যোজন কমিশন সহমতের ভিত্তিতে রাজ্যগুলির জন্য যে বরাদ্দ করে আসছিল, তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। ২০১৪ পর্যন্ত গ্যাডগিল ফর্মুলা মেনে রাজ্যগুলির জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হত। সেক্ষেত্রে রাজ্যগুলির জনসংখ্যা, জিডিপি, মাথা পিছু আয়, শিল্পে অগ্রগতি প্রভৃতি যাচাই করা হত।

যোজনা কমিশনের অবলুপ্তির অর্থ, অতীতের এই ধারা আর মিনার দায়বদ্ধতা থাকছে না। অর্থাৎ নিজের পছন্দ অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ করতে পারবে কেন্দ্র। রাজ্যগুলির মধ্যে অর্থবণ্টনে বৈষম্য তৈরি করা হল। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে মোদির দ্বিতীয় পদক্ষেপ হল, জাতীয় উন্নয়ন পরিষদ গুটিয়ে দেওয়া। ১৯৮৯-এ ভি পি সিং সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই মঞ্চেই বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করতেন।

২০১৫-র জানুয়ারিতে মোদি ঘোষণা করেন, নীতি আয়োগ তৈরির পর জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের কোনও প্রয়োজন নেই এবং এটিকে বাতিল করা উচিত। তার পর থেকে গত ৮ বছরে এনডিসি-র একটিও বৈঠক ডাকেননি তিনি।

দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই মোদি সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে দেন। এই ধারায় জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, সংবিধানের ৩৭১ ধারায় উত্তর-পূর্বের ৬টি রাজ্যকেও একই ধরনের বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই ধারায় কোনও হাত পড়েনি।

ভারতীয় গণতন্ত্রে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে পারস্পরিক সহমতের যে রীতি এতকাল ধরে চলে আসছে, তাকে পদদলিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া ছোট ছোট অসংখ্য আঘাত এসেছে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর, যার শিকার হয়েছে মুসলিম, সাংবাদিক থেকে শুরু করে দেশের নাগরিক সমাজ, এমনকি ছাত্রছাত্রীরাও। সঙ্ঘ হিন্দুরাষ্ট্রের যে ধুয়ো তুলেছে, তাকে বাস্তবায়িত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াতে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে সঙ্ঘ পরিবার। মুসলিম মানেই হিন্দু বিদ্বেষী, দেশের সর্বত্র অত্যন্ত সুকৌশলে এই তত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এরই সর্বশেষ নজির হল ‘কাশ্মীর ফাইলস’ ছবিটি। যে ছবি নিয়ে উচ্ছ্বসিত স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। গত কয়েক দশকে কাশ্মীরে হিংসা নিয়ে বেশ কয়েকটি ছবি তৈরি করা হয়েছে। সব কটি ছবিতেই কাশ্মীরের ঘটনাবলীর পিছনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার ইন্ধন তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু কাশ্মীর ফাইলস ছবিটিতে যেভাবে সাধারণ মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে, তা অতীতে কখনও হয়নি। ভারতের মুসলিমরা হিন্দুদের পক্ষে বিপজ্জনক, ছবিটিতে পরোক্ষে এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন পরিচালক। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের হল, ছবিটির সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী।

মোদি কি জানেন না, কাশ্মীরে জঙ্গিরা হাজার হাজার মুসলিমকে হত্যা করেছে, যা হিন্দু পণ্ডিতদের তুলনায় সংখ্যায় অনেক বেশি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তথ্যেই তা স্পষ্ট।

ভি পি সিং, অটল বিহারী বাজপেয়ী থেকে মনমোহন সিং, প্রত্যেক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীই এটি জানতেন। সেই অনুযায়ী, জেকেএলএফ এবং হুরিয়তকে হিজবূল মুজাহিদিন ও জৈশ-ই-মহম্মদ থেকে দূরে রাখার কৌশল নিয়েছিলেন। কিন্তু এর ঠিক উল্টো পথ নিয়েছেন মোদি।

বিপদঘণ্টি নিয়ে দেশবাসীর সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। একসময় এদেশের নেতারাই ব্রিটিশদের উৎখাত করেছিলেন। এখন সেই দায়িত্ব নিতে হবে সোনিয়া ও রাহুল গান্ধীকে। কিন্তু তাঁদের কেউ সেভাবে মুখ খুলছেন না। যা বলছেন, তা অনেকটা দায়সারা গোছের। যখন মোদি কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা করলেন এবং সেখানে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করলেন, তখন এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে কোনও পিটিশন পেশ করেনি কংগ্রেস। সোনিয়া এবং রাহুল, দুজনেই চুপ ছিলেন। সংসদে বলার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন চিদম্বরমের ওপর।

২ বছর পর ২০২১-এর সেপ্টেম্বরে রাহুল যখন জম্মু সফরে গেলেন, তখন জম্মু-কাশ্মীরে পুরোপুরি রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার দাবি তুললেও ৩৭০ ধারা নিয়ে নীরব ছিলেন।

কংগ্রেসের এই মৌনতার অর্থ, ভারতের রাজনীতিতে বিজেপির শক্তি আরও বৃদ্ধি পাওয়া। আর তাই গান্ধী পরিবারের রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার দাবি যেমন উঠেছে, তেমনই দলের পুনর্গঠনের দাবিও উঠেছে। কিন্তু এতে রোগ তো সারবেই না। বরং আরও খারাপের দিকে যাবে। একথা সত্যি যে, একসময় দেশে কংগ্রেসের যে গণভিত্তি ছিল, এখন তা অনেক দুর্বল। দেশের মাত্র দুটি রাজ্যে এখন কংগ্রেসের দখলে রয়েছে, যা আগে কখনও দেখা যায়নি।

সোনিয়া গান্ধী দলের মধ্যে যৌথ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে চান। বিক্ষুব্ধ শিবিরের সঙ্গে বৈঠকে সেই বার্তা দিয়েছেন তিনি। কিন্তু সেটা, ল একটা দিক। কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, আগামী দিনের জন্য দিশা তৈরি করা, যা কংগ্রেসকে আবার মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যাবে। সেই লক্ষ্যে এগোতে গেলে, আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে বোঝাপড়া আরও মজবুত করতে হবে।
যেমনটি রাহুল করেছিলেন ২০১৮তে কর্নাটকে কুমারস্বামীর জনতা দল সেকুলারকে বিধানসভায় নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে। ২০১৯-এ ১৬ জন এবং জেডিএস বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় এই কৌশল শেষ পর্যন্ত অবশ্য কাজে আসেনি। কিন্তু রাহুল একটা বার্তা দিতে পেরেছেন।

চলতি বছরের শেষ দিকে কংগ্রেসে সাংগঠনিক নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু তার আগে থেকেই সলতে পাকানোর কাজ শুরু করতে হবে। বিজেপির বিকল্প প্রধান শক্তি হিসেবে কংগ্রেসকে উঠে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করতে হবে। একটা জিনিস বোঝা দরকার, কোনও আঞ্চলিক দল নয়, ২০২৪-এ মোদির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে হলে, কংগ্রেসকে এখন থেকেই সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img