সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, শিক্ষাবিদ
বর্তমানে আমরা এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলেছি। এমন পরিস্থিতি হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী মানবসমাজ আর দেখেনি। কোভিড-১৯ (Covid-19) মানুষের জীবন-জীবিকা, এমনকি তার অস্তিত্ব পর্যন্ত বিপন্ন করে তুলেছে। একে শুধু একটা মহামারী বললে কম বলা হবে, আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক অবস্থান আজ করোনার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত।
এই রোগ ভাবতে বাধ্য করছে, কোনটি আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের জীবনের অভিমুখ কোন দিকে হবে। আমরা যখন প্রতিনিয়ত ভেবে চলেছি এই অতিমারী থেকে বাঁচার উপায়, তখন একটি অভিব্যক্তি এ ব্যাপারে প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে। তা হলো ‘সামাজিক দূরত্ব’ বা ‘social distancing’। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে একটা প্রশ্ন উঠে আসে—আমাদের কি সামাজিক দূরত্ব দরকার? নাকি আমরা আসলে শারীরিক দূরত্বের কথা ভাবছি? ‘সামাজিক দূরত্ব’ কথাটার মধ্যে একটা কূটাভাস আছে। এটি শুধু শারীরিক নয়, মনস্তাত্ত্বিক দূরত্বকেও বোঝায়। আমাদের ভাবতে হবে, এই মহামারীকালে আমরা একে অপরের পাশে থাকবো কি না, থাকলে সামাজিকভাবেই থাকতে হবে, মনের মধ্যে পাঁচিল তুলে থাকা সম্ভব নয়।
কিন্তু করোনা থেকে বাঁচতে একটা পাঁচিল তুলতেই হবে। সেটা শারীরিক হওয়াটাই শ্রেয়। আমরা জানি, “Man is a social animal”। কোনো মানুষই একা বাঁচতে পারে না। তাহলে সামাজিক দূরত্ব কীসের? আমাদের আসলে কী দরকার, সামাজিক দূরত্ব না সামাজিক বন্ধন? নাকি শারীরিক দূরত্ব? এটা কিন্তু ঠিক করতে হবে আমাদেরকেই। ভাবতে হবে, সামাজিক দূরত্ব সত্যিই সাহায্য করবে কি? তার চেয়ে বরং ভালো আবেগ ও সম্পর্কের নৈকট্য, হোকই না তা শারীরিকভাবে দূরে থেকে।
সম্পর্ক কখনোই দূরত্বের উপর নির্ভর করে না। যদি করে, তাহলে সেটা নিয়ে যথেষ্ট ভাবার আছে। ভৌগোলিক দূরত্ব কখনোই কোনো মানবিক ভাবনার পরিপন্থী হতে পারে না, কিন্তু মানসিক দূরত্ব পারে। আর এই ‘সামাজিক দূরত্ব’ আসলে মানসিক দূরত্বেরই প্রতিফলন। ‘আম্ফান’ ঝড়ের তাণ্ডবের পরে একটা ছবি বিভিন্ন সংবাদপত্রে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। একটি বাচ্চা ছেলে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে খাবার নিচ্ছে। ছবিটা দেখে অনেকেই ব্যথা অনুভব করেছিলাম, যার ফলশ্রুতিতে সরকারি-বেসরকারি বহু সংগঠন এবং বহু ব্যক্তি নিজের তাগিদে নিপীড়িত মানুষের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করে।
করোনার প্রকোপ চলাকালীন, বিশেষত আম্ফান বা ইয়াস-এর পরে অর্থ, খাদ্য, ওষুধ বা গুরুতর মুহূর্তে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া—সব ক্ষেত্রেই অসমর্থ, বয়স্কদের সাহায্য করতে ছুটে এসেছে আশেপাশের মানুষ। প্রশ্ন হল, সত্যিই সামাজিকভাবে দূরে সরে গেলে কি আমরা ছুটে যেতাম মানষের সাহায্যার্থে? কোভিড-১৯কে (Covid-19) কেন্দ্র করে বহু মানুষের রুটিরুজি ব্যাহত হয়েছে, পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা বিপাকে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু সংগঠন নানাভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
রোগের ভয় না করে মানুষের মাঝখানে ত্রাণ নিয়ে অনেকে পৌঁছে যাচ্ছেন। এই যে সহমর্মিতা ও সংবেদনশীলতা কি সামাজিকভাবে দূরত্ব হলে সম্ভবপর হত? শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়িয়েছে—এটাই দরকার। আমরা সবাই একই সমাজের অঙ্গ; তাই আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করতে হবে সামাজিক নয়, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে।
করোনার দাপটে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাপ্রদান আজ আর সম্ভব নয় বলে শুরু হয়েছে ফলিত শিক্ষা বা ‘virtual teaching’। শিক্ষক-শিক্ষিকারা তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে পাঠদান করছেন। টেলিভিশন, কম্পিউটার, স্মার্টফোন এসব ব্যবহার হচ্ছে যাতে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত না হয়। শিক্ষক-শিক্ষিকারা দূরে থেকেও অনলাইনে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন নিয়মিত। এটা কি সামাজিক দূরত্বের নিদর্শন? এই ধারণা আরও বেশি প্রযোজ্য চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যাপারে। তাঁরা পরিবার-পরিজন ছেড়ে শুধু রোগীর কথা মাথায় রেখে নিজেদের সুরক্ষা ভুলে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। সামাজিক দায়িত্ববোধ না থাকলে এটা হয় না।
সামাজিক দূরত্বের ভাবনায় বিচ্ছিন্নতাই প্রকাশ পায়। আমরা সচেতন থাকবো শারীরিকভাবে, কিন্তু মানসিকভাবে অবচেতন না হয়ে। এ প্রসঙ্গে আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির কথা স্মরণ করা যেতে পারে: “If a free society cannot help the many who are poor, it cannot save the few who are rich”. আমাদের পৃথিবীতে থাকার একটা মূল্য দেওয়া দরকার এবং তা দিতে হবে সামাজিক কাজের মাধ্যমে। সামাজিক দূরত্ব রেখে কি আর সামাজিক কাজ হয়?
বর্তমানে করোনা-পরিস্থিতিতে আমরা অনেক সামাজিক ধ্বংসাত্মক কাজ দেখেছি—পারিবারিক কলহ, আবেগজনিত সমস্যা, মানসিক অবসাদ। শিশুরা সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে একলা থাকা জীবনে একটা কঠিন জিনিস। তাই করোনা ভাইরাসকে যথার্থভাবে পরাজিত করতে হলে, বিধিনিষেধ পালন যেমন করতে হবে, তেমনি করোনার দ্বারা সামাজিক ক্ষতির ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে।
করোনার হাতে ধরাশায়ী সারা পৃথিবী আজ একটি চেষ্টায় ব্যস্ত, তা হল, প্রতিষেধক আবিষ্কার। সামাজিকভাবে বন্ধুত্ব না হলে কী করে সবাই মিলে সমস্যার মোকাবিলা করব? এখন সব মানুষের ভাগ্য একসূত্রে বাঁধা। ভৌগোলিকভাবে দূরে থেকেও ঐক্যবদ্ধ থাকাটাই এই সময়ের দাবি। এই বিশ্বব্যাপী সংকটে, আমাদের সবাইকে ভালোবাসা, সহমর্মিতা, আন্তরিকতার সঙ্গে সবার কথা ভাবতে হবে। সামাজিকভাবে দূরে থেকে কিভাবে তা বাস্তবে সফল করা যায়?
স্বামী বিবেকানন্দের (Swami Vivekananda) একটি উক্তি এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়, “তারাই যথার্থভাবে বাঁচে, যারা অন্যের জন্য বাঁচে।” জীবন-জীবিকার এই সংঘাতের কালে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে আমাদের সামাজিকভাবে কাছে থাকতে হবে, আর সেটাই হবে করোনার প্রভাবকে সর্বতোভাবে নির্মূল করার শ্রেষ্ঠ প্রচেষ্টা।