হোমক্রাইম রিপোর্টারCRIME REPORTER:৩০ বছর আগের রেখা,আর আজকের রিয়া, যেন এক কাহিনী

CRIME REPORTER:৩০ বছর আগের রেখা,আর আজকের রিয়া, যেন এক কাহিনী

CRIME REPORTER:৩০ বছর আগের রেখা,আর আজকের রিয়া, যেন এক কাহিনী

(CRIME REPORTER : এই লেখায় আমরা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরব অপরাধ জগতের নানা কাহিনী। উঠে আসবে বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী। বিখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলির গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে আপনাদের সামনে হাজির করবেন বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর।)

হীরক কর : বলিউডে সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। এ যেন ৩০ বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ৩০ বছর আগে এক অভিনেত্রীর স্বামী মারা যাওয়ায় তাঁকে ডাইনি আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন পরিচালক, প্রযোজকরা। আজ ৩০ বছর পরে এক উঠতি অভিনেত্রীর প্রেমিক মারা যাওয়ায় তাঁর গায়েও ডাইনি তকমা লেগেছে।আপাতত তিনি জেলে। অনিশ্চিত তাঁর অভিনয় কেরিয়ারও।

1990 থেকে 2020। সময়ের হিসেবে পাক্কা তিরিশ বছর। ভানুরেখা জেমিনি গণেশন আর বঙ্গতনয়া রিয়া চক্রবর্তীর জীবনের বর্তমান অধ্যায়ের মধ্যে ফারাক কোথায়। একটা ঘটনা দুজনের জীবনকে কোথাও না কোথাও এসে মিলিয়ে দেয়। দুজনেরই নাম প্রেমিকের মৃত্যুর সঙ্গে জুড়ে যায়।

সুশান্তের মৃত্যু রহস্যের তদন্ত সিবিআই আইপিসি 306 ধারা অর্থাৎ আত্মহত্যার প্ররোচনাকে সামনে রেখেই করছে। ধারা 302 অর্থাৎ খুনের তত্ত্ব মাথায় রেখে নয়। কেননা এমন কোনও তথ্যপ্রমাণ এখনও সিবিআইয়ের হাতে আসেনি। তদন্তে খুনের তথ্য প্রমাণ যদি মেলে, তাহলে রাজপুত মামলায় 302 ধারা যুক্ত হতে পারে। কিন্তু এই মামলায় আত্মহত্যাকে সামনে রেখেই তদন্ত করছে সিবিআই।

রিয়া চক্রবর্তী যখনই সিবিআই, ইডি বা এনসিবি দফতরে গেছেন, তখনই তাঁর পিছু নিয়েছে মিডিয়া । এমনকি তাঁর সান্তাক্রুজের বাড়ি সামনে প্রবেশ পথ কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তাই একদিন ক্রুদ্ধ হয়ে সান্তাক্রুজ থানায় মিডিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন রিয়া চক্রবর্তী।

৩০ বছর আগে দেশে নিউজ চ্যানেলের নামে বন্যার বেনো জল ছিল না। চ্যানেল বলতে ছিল একমাত্র দূরদর্শন। আর ছিল কিছু খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন। তাই ক্যামেরা, বুম নিয়ে কোনও তারকার পিছু নিতে হয়নি। বাইট নিতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি এসব ছিল না। এখনকার তুলনায় মিডিয়া ছিল অনেক ভদ্র।

ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রেখা তখন প্রতিষ্ঠিত। সুন্দরী অভিনেত্রী। এমনকি সারা ভারতের ছেলেবুড়ো সব বয়সের পুরুষই রেখার প্রেমে পাগল। রেখার সম্পর্কে বলা হয়, বয়সের সঙ্গে তাঁর সৌন্দর্য যেন বেড়েছে।

পঞ্চাশের দশকের মাদ্রাজ, আজকের চেন্নাইয়ে জন্ম রেখার। 10 অক্টোবর, 1954 । পরিবারেরই ছিল সিনেমার আবহ। মা পুষ্পাবলী ছিলেন খ্যাতনামা অভিনেত্রী। বাবা জেমিনি গণেশন দক্ষিণ ভারতের নামকরা অভিনেতা, প্রযোজক-পরিচালক। এ হেন অভিনেত্রী অভিনেতার কন্যা ছিলেন রেখা। ছোট বেলা থেকেই রেখা বাবার স্নেহ-আদর পাননি। একটা সময় আসে বাবা জেমিনি গণেশন পরিবারকে ছেড়ে দেন। মা পুষ্পাবলী সিনেমা জগতে কাজ করছিলেন। কাজ পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। রেখার পড়াশোনা বন্ধ করে দেন মা। ১৪ বছর বয়সেই মাদ্রাজ ছেড়ে বোম্বে চলে আসেন। শুরু করেন ফিল্মি কেরিয়ার।

প্রথম যখন ছবি করেন তখন তাঁর বয়স ১৫। বিপরীতে হিরো বিশ্বজিৎ। রেখাকে বলা হয়নি এ
নায়ককে কিস করতে হবে। যেমনি পরিচালক অ্যাকশান বলেন, বিশ্বজিত রেখাকে চুম্বন করতে শুরু করেন। রেখা অবাক হয়ে যান। পরিচালক কাটও বলেন নি। চার-পাঁচ মিনিট ধরে এই সিন চলতে থাকে। হঠৎ পরিচালক দেখেন, রেখা হাউহাউ করে কাঁদছেন। আর বলছেন এ কি হচ্ছে!

কিন্তু ধীরে ধীরে রেখা বলিউডে নিজের জায়গা করে নেন । সিমলায় শুটিং করতে গিয়ে জিতেন্দ্রের সঙ্গে প্রথমবার তাঁর প্রেম । জিতেন্দ্র তখন এক জনের প্রেমে পড়েছিলেন। তাঁকেই পরে বিয়ে করেন। তাই রেখা-জিতেন্দ্রর সম্পর্ক বেশিদূর এগোয়নি। এরপরে রেখার জীবনে আসেন বিনোদ মেহেরা। বলিউডের ওয়াকিবহাল মহলের মতে, রেখাকে সঠিকভাবে জেনেছিলেন বিনোদ মেহেরা।

এমনও খবর ছিল কলকাতায় এসে বিনোদ মেহেরা রেখাকে বিয়ে করেছিলেন। রেখাকে নিয়ে কলকাতা থেকে বিনোদ সরাসরি বম্বে চলে যান । সটান নিয়ে যান নিজের মায়ের কাছে। রেখা বিনোদ মেহেরার মাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেলে তাঁর মায়ের এত রাগ হয় যে, জুতো খুলে রেখাকে মারতে যান। বেইজ্জত হয়ে রেখা কোনও রকমে ঘর থেকে বেরিয়ে লিফটের দিকে যান। তখন প্রতিবেশীরা একজোট হয়ে বাইরে এসে মজা দেখছিলেন। বিনোদ মেহেরা হাতে পায়ে ধরে রেখাকে নিজের বাড়িতে চলে যেতে বলেন। বোঝান, সব কিছু ঠিক হয়ে গেলে রেখাকে তিনি ঘরে তুলবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। পরে দুজন দুজনের পথ বেছে নেন। যদিও রেখা পরে এক ইন্টারভিউয়ে বলেছিলেন বিনোদকে তিনি কখনওই বিয়ে করেননি।

এরপর এক সময়ের দক্ষ অভিনেতা জীবনের পুত্র কিরণকুমারের সঙ্গে রেখার রিলেশনশিপ হয়। বেশ কিছুদিন সেই সম্পর্ক চলে। এরই মধ্যে রিলিজ হয় ‘মুকাদ্দার কী সিকেন্দার ‘, সিলসিলা, রেখা-অমিতাভের একের পর এক ছবি। লছমনঝোলায় ‘গঙ্গা কি সৌগন্ধ’ ছবির শুটিং করার সময় রেখা ও অমিতাভ বচ্চন একে অপরের কাছাকাছি আসেন। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁদের প্রেমকাহিনী নিয়ে চলতে থাকে নানা গুঞ্জন।

এই সম্পর্ক বহুদিন পর্যন্ত চলে। এঁদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয় ‘কুলি’ ছবিটির শুটিংয়ের সময় ভিলেন পুনিত ইসারের ঘুঁষি সামলাতে না পেরে অমিতাভ একটি টেবিলের কোণে ধাক্কা খেয়ে গুরুতর জখম হন। ব্রিচ ক্যানেডি হাসপাতালে যমে মানুষে টানাটানি চলে । ওই সময় জয়া ভাদুড়ি চোখে পড়ার মত স্বামী সেবা করেন। অমিতাভকে আগলে আগলে রাখেন । এরই মধ্যে রেখা অমিতাভকে দেখতে হাসপাতালে পৌঁছন। সবাইকে ঢুকতে দিয়েছিলেন জয়া ভাদুড়ি । কিন্তু অমিতাভর কেবিনে ঢোকার অনুমতি পাননি রেখা।

দরজা থেকে উঁকি মেরে প্রিয় পুরুষকে দেখেই রেখাকে চলে যেতে হয়। ওই ঘটনায় পর অমিতাভ-রেখার সম্পর্ক আগের মত থাকেনি। ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরি হয়। সিমি গাড়োয়ালের এক ‘শো’তে সিমি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, অমিতাভকে ভালোবাসো ? রেখার জবাব ছিল, হ্যাঁ, সেই সঙ্গে এটাও বলেন, ভারতে এমন কোনও মহিলা নেই, যিনি অমিতাভ বচ্চনকে ভালোবাসেন না । বলিউডে আজও প্রচার, রেখা যে হামেশাই সিঁথিতে সিঁদুর দেন, গলায় মঙ্গলসূত্র পড়েন, সবটাই অমিতাভের জন্য ।

রেখার ‘লাভ লাইফ’-এ চিরকাল চরাই উতরাই ছিল। কখনো পরিণতি পায়নি। আশির দশকের শেষে দিল্লির এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে রেখার আলাপ হয়। যার নাম মুকেশ আগরওয়াল। ওই সময়ের বিখ্যাত কোম্পানি ‘হটলাইন গ্রুপ ‘ এবং ‘ নিকিতাশা’ ব্র্যান্ডের চেয়ারম্যান অর্থাৎ মালিক ছিলেন। আর ছিলেন রেখার অন্ধ ফ্যান। সিনেমায় দেখে দেখে রেখার দিওয়ানা হয়ে পড়েছিলেন। রেখার সঙ্গে মোলাকাত করার জন্য মুকেশ প্রচুর চেষ্টা করেন। ঘন্টার পর ঘন্টা ফিল্ম স্টুডিওর বাইরে অপেক্ষা করেন। বর্ষায় ভিজে রেখার শুটিং দেখার চেষ্টা করতেন। গাড়ি নিয়ে রেখার গাড়ির পিছনে ছুটতেন। যদিও রেখা কোনও দিন পাত্তা দেননি।

এরই মধ্যে দিল্লিতে দুটি পার্টিতে দুজনের দেখা হয়। বড় ব্যবসায়ী হবার কারণে এলিট সমাজের নানান পার্টিতে আমন্ত্রণ পেতেন মুকেশ। নানাভাবে রেখার নজর কাড়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু বরফ গলে নি । একদিন আচমকা রেখা এক বন্ধুর কাছ থেকে মুকেশ আগরওয়ালের ফোন নম্বর নেন এবং কথা বলা শুরু করেন। এর এক মাসের মধ্যে মুম্বই গিয়ে রেখার সঙ্গে ‘ডেট’ করেন মুকেশ। রেখাও দিল্লি এসে মুকেশের সঙ্গে দেখা করেন। প্রথমবার আলাপের পরই তাঁর বাগানবাড়ীতে একটি অনুষ্ঠানে রেখাকে আমন্ত্রণ জানান মুকেশ। সেখানে রেখাই ছিলেন আকর্ষণের মূল কেন্দ্র বিন্দু।

এক মাসের মধ্যেই তাঁদের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। দুজনেই সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা বিয়ে করবেন। বারবার প্রেমে ব্যর্থ হয়ে রেখাও জীবনে স্থায়িত্ব চাইছিলেন। মুকেশ আগরওয়ালকে দেখে রেখার মনে হয়েছিল হয়ত এবার জীবনে স্থায়িত্ব আসবে। বিয়ে খুবই গোপনে হয়। ঘটনা ১৯৯০ সালের। হঠাৎ করেই মুকেশের সঙ্গে বিয়েটা সেরে ফেলেন রেখা। অভিনেত্রীর পদবী বদলে যায়। যদিও এই বিয়েতে রেখা কিংবা মুকেশ কারোর পরিবারই উপস্থিত ছিলেন না।

জুহু-র মুক্তেশ্বর দেবালয় বলে একটি মন্দিরে গিয়ে হঠাৎই পুরোহিতকে তাঁদের বিয়ে দিতে বলেন মুকেশ, বিয়ে হয়ে যায়। যদিও ওই মন্দিরে সন্ধ্যা আরতির পর কোনও বিয়ের অনুষ্ঠান করা নিষিদ্ধ ছিল। রেখা-মুকেশের বিয়ে দিয়ে মন্দিরের নিয়ম ভাঙার জন্য ওই পুরোহিতকে নাকি মন্দির থেকে বিতাড়িতও হতে হয়েছিল।

 এরপর ১৯৯০ সালের ১৫ এপ্রিল। তিরুপতি মন্দিরে রেখা ও মুকেশের আরও একটি বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। সেখানে অবশ্য রেখার বাবা-মা উপস্থিত ছিলেন।রেখা বিয়ের পর তাঁর স্বামীকে নিয়ে হেমামালিনীর বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাঁর বিয়ের খবর শুনে হেমামালিনীও চমকে যান বলে জানা যায়। এছাড়া রেখা তাঁর বিয়ের কথা জানিয়েছিলেন অভিনেত্রী দীপ্তি নাভালকে। মিডিয়াতে কিছু দিন পর এই বিয়ের খবর ‘লিক’ হয়ে যায়। রেখা স্বীকার করেন, তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। মুকেশ আগরওয়াল তাঁর স্বামী ।

বিয়ের পর লন্ডনে মুকেশের সঙ্গে মধুচন্দ্রিমাতেও গিয়েছিলেন রেখা। পরে তাঁদের মনে হয় তাঁরা দুজনে পৃথক ব্যক্তিত্বের মানুষ। বিয়ের সাত মাসের মধ্যে দুজনের সম্পর্কে সমস্যার সূত্রপাত হয়। রেখার যে আত্মজীবনী লেখা হয়েছে, তার থেকে জানা যায়, বিয়ের কয়েক দিনের মধ্যে রেখা জানতে পারেন, ডিপ্রেশনের শিকার মুকেশ। যেমন রিলেশনসিপের কিছু দিনের মধ্যে সুশান্ত সম্পর্কে জেনে ছিলেন রিয়া।

সুশান্ত যা করেননি মুকেশ তা করেছিলেন । ডিপ্রেশনের বিষয়টা সুশান্ত রিয়ার কাছে গোপন করেননি। কিন্তু মুকেশ বিষয়টা রেখার কাছে লুকিয়ে ছিলেন। রেখা এটা নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকতেন। রেখা ও মুকেশের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। যেখানে মুকেশ পার্টি করতে পছন্দ করতেন। তখন রেখা নিভৃতে জীবন কাটাতে পছন্দ করতেন।

পরবর্তীকালে মুকেশ ব্যবসার দিকে মন দেওয়া ছেড়ে দেন। দিল্লিতে ছিলেন কিন্তু কোনও কারণ ছাড়াই মুম্বইয়ে চলে আসতেন। রেখার শুটিং লোকেশনে পৌঁছে যেতেন। ঘন্টার পর ঘন্টা এমনিই বসে থাকতেন। কাজকর্ম ছেড়ে রেখার ঘরে অপেক্ষা করতেন। এতে মুকেশের ব্যবসা ডুবতে থাকে। বলিউডের সমস্ত পার্টিতে রেখার সঙ্গে গিয়ে অদ্ভুত আচরণ করতেন বলে শোনা যায়। যাতে নাকি রেখাও অস্বস্তিতে পড়তেন।

মুকেশের আচরণে বিরক্ত রেখা বিবাহ-বিচ্ছেদের কথা ভাবতে শুরু করেন। অন্যদিকে এই পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন মুকেশ। ডিপ্রেশনের ব্যাপারটা জানতে পেরে মুকেশের থেকে দূরত্ব বাড়াতে থাকেন রেখা। একটা সময় মুকেশের সঙ্গে দেখা করতেই চাইতেন না। ধীরে ধীরে মুকেশ আগরওয়াল ভিতরে ভিতরে ক্ষইতে থাকেন ।

মুকেশ রেখাকে বলেছিলেন, রেখার জীবনে যেমন অমিতাভ বচ্চন আছেন, তাঁর জীবনেও একজন আছেন। আর ইনি হলেন তাঁর মনোবিদ বন্ধু আকাশ বাজাজ, যাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে, দুই সন্তানের সঙ্গে আকাশ একা থাকেন। রেখার সঙ্গে আলাপের পর আকাশের স্ত্রীর সঙ্গে মুকেশের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন মুকেশ। ওই মহিলা ও তাঁর সন্তানদের সঙ্গে মুকেশ নাকি বেড়াতেও যেতেন। তবে রেখার সঙ্গে আলাপের পর তিনি তাঁকে বিয়ে করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু রেখার মনে হয় মুকেশ ‘বাই-সেক্সুয়াল ‘। এটাও মুকেশের থেকে রেখার দূরত্ব বাড়ার কারণ বলে অনেকেই মনে করেন।

বিয়ের ৭ মাসও যায়নি। 2 অক্টোবর, ১৯৯০। সেদিন ছিল গান্ধী জয়ন্তী। রেখা একটা স্টেজ শোয়ের জন্য লন্ডন গিয়েছিলেন। মুকেশ দিল্লির বাড়িতে ছিলেন। রেখার কাছে একটা ফোন আসে। ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন রেখার ননদ, মুকেশের বোন। বলেন, রেখার ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে পড়েছেন মুকেশ। অর্থাৎ আত্মহত্যা করেছেন। রেখার কাছে এই ফোনালাপ বিস্ফোরণের মত ছিল। রেখা রিসিভার ধরে বসে পড়েন। এরই মধ্যে এই খবর দ্রুত ছড়িয়ে পরে।

রেখার ওড়না কাহিনীতে পরিণত হয়। বলা হয়, শেষ সময় পর্যন্ত রেখার প্রেমে বদ্ধ পাগল ছিলেন মুকেশ । রেখার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় মুকেশ পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলেন। ওই ডিপ্রেশনে রেখার দোপাট্টা দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।

লন্ডনে রেখার কাছে খবর পৌঁছতেই তিনি তড়িঘড়ি ভারতে চলে আসেন। কিন্তু ভারতে আসতেই অন্য কাহিনী শুরু হয়। যা রেখার অনুকূলে ছিল না। এই কাহিনী শুরু করেন মুকেশ আগরওয়ালের মা । মুকেশ আগরওয়ালের মা মিডিয়াকে যা বলেন, তা অনেকটা আম ভারতের শাশুড়ি-বউয়ের কাহিনীর মতই । মায়ের দুটো লাইন মুকেশের কাহিনী নব্বই ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

রেখা ঘরে ঘরে হিন্দি সিনেমার ভ্যাম্পের মত বদনাম পেয়ে গিয়েছিলেন। তরতাজা ছেলে আচমকা মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে মুকেশের মা তোপ দাগেন রেখার দিকে । ৩ অক্টোবর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “ও ডাইন মেরি বেটে কো খাঁকে গেয়ি “। ওই ডাইন আর কেউ নয়, রেখা। তিনি আরও বলেছিলেন,”ভগবান উসে কভি মাফ নেহি করে গি”।

মুকেশের ছোট ভাই অনিল আগরওয়াল বলেছিলেন, “আমার ভাই রেখার সঙ্গে সাচ্চা প্রেম করতেন। রেখার জন্য সব কিছুই করতে পারতেন । জান দিতেও পারত, জান নিতেও পারত। রেখা ওর সঙ্গে যা করেছে, ও বরদাস্ত করতে পারেনি। আর এই কারণেই ও আত্মহত্যা করেছে।”

অনিল এমনও অভিযোগ করেছিলেন, রেখা মুকেশকে জেনেবুঝে বিয়ে করেছে, স্লেফ মুকেশের পয়সার জন্য। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, 2 অক্টোবর যেদিন মুকেশ আত্মহত্যা করেছিলেন সেদিন তিনি খুবই খুশি ছিলেন। স্বাভাবিক ছিলেন। হঠৎ কী হল কে জানে?

এরপর দেশ জুড়ে কাগজে কাগজে খবর ছাপা হয়। ম্যাগাজিনে ম্যাগাজিনে গসিপ ছড়ায়। দেখতে দেখতে রেখা দেশের কোণে কোণে ভিলেন বনে যান।

এমনকী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বড় বড় লোক পরিচালক-প্রযোজক রেখাকে এড়িয়ে চলতে থাকেন । সুভাষ ঘাইয়ের মত পরিচালক ওই সময়ে বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, “রেখা পুরো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মুখ কালিমালিপ্ত করেছেন। এটা সহজে ধোয়া যাবে না। রেখার এই অসভ্যতার পর , মুকেশের এই আত্মহত্যার পর দেশের কেউই বলিউডের কোনও অভিনেত্রীকে বিয়ে করার জন্য তৈরি হবেন না। হাজার বার চিন্তা করবে।”

তিনি আরও বলেছিলেন, রেখার প্রফেশনাল কেরিয়ারের দিক থেকে মুশকিল হবে। কোনও পরিচালক হয়ত রেখাকে কাস্টিংই করবেন না। সিনেমা হলের দর্শক কীভাবে মেনে নেবেন ভারতের নারী, আর ন্যায় বিচারের দেবী রেখা !

এর থেকে বোঝা যায়, ওই সময়ে বলিউডে রেখাকে কী রকম ঘৃণার চোখে দেখা হয়েছিল। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও ভিলেনই হয়েছিলেন রেখা, সহকর্মীরাও তাঁর সঙ্গে ছিলেন না। বেশ কিছু ছবিতে অনুপম খের সেই সময় রেখার সঙ্গে কাজ করেছিলেন । তাঁর বক্তব্য ছিল, “Now she became the national vamp. I don’t know how to react to her. যদি কোনো দিন আমি রেখার সামানা সামনি হই, জানি না আমি তাকে কি ভাবে ফেস করব।

এই একটা দুর্ঘটনা রেখার জীবন পুরো বদলে দিয়েছিল। এই পুরো সুইসাইডের খবর মিডিয়াতে ধারাবাহিক ভাবে ছাপা হতে থাকে। রেখাকে আক্রমণ করে হেডলাইন হতে থাকে । যেমন ‘শো টাইম’, নভেম্বর 1990 তে হেড লাইন হয়, The black widow. । Rekha for murdering mukesh agarwal, এই ধরনের হেড লাইন ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন কাগজে ।

মুকেশ আগরওয়ালের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সবাই সেই সময় রেখাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিতে কুন্ঠা করেনি। এমনকি বলিউডের সর্বকালের সেরা সুন্দরীকে খুনি বলতেও ছাড়েনি। তাঁর দর্শকরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। বিভিন্ন শহরের মানুষ রেখার ফিল্ম বয়কট করছিলেন। ছবির পোস্টারে পর্যন্ত রেখার মুখে কালি লেপে দেওয়া হয়েছিল।

রেখা কিন্তু কোনোওদিনই এর পাল্টা জবাব দেননি। এত কিছুর পরেও কিছু সময় গঙ্গা দিয়ে বয়ে যেতেই রেখা বলিউডে কামব্যাক করেন। ফিল্ম সুপার হিট হয়। কোটি কোটি ফ্যান যার , সেই রেখা কিছু দিনের জন্য সকালের ভিলেন ছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তা কাটিয়ে ওঠেন। শুটিং শুরু করেন। আওয়ার্ড ফাংশানে যাওয়া আরম্ভ করেন। ওই অনুপম খের, ওই সুভাষ ঘাই তাঁর সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন ।

একটা ঘটনা রেখার জীবন লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। রেখা কিন্তু চুপ ছিলেন। মুকেশের মা, ভাই আর ওই প্রসঙ্গ তোলেননি। কিন্তু 1990তে যা ছিল, 2020তেও দেশ ও দশের মানসিকতা বদলায়নি। 1990 তে দাবি উঠেছিল মুকেশ আগরওয়ালকে খুন করেছেন রেখা। তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো উচিত। সেদিন সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রায়াল ছিল না। কিন্তু আদালতের আগেই মিডিয়া ট্রায়ালে রেখা দোষী সাব্যস্ত ছিলেন। আজ যেমন সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রায়ালে দোষী সাব্যস্ত রিয়া চক্রবর্তী।

1990তে মুকেশ আগরওয়াল কেস যে তিমিরে ছিল, আজও দিল্লি পুলিশের কাছে সেই তিমিরেই আছে।কোনও অগ্রগতি নেই। ওই কেসে কিছু হয়নি। কিন্তু রিয়া চক্রবর্তী-সুশান্ত সিং রাজপুতের কেসে ফয়সলা একদিন আসবেই। সিবিআই একদিন রিপোর্ট দেবে । আদালত একদিন রায় দেবে।

তবে রেখার স্বামীর পুরনো বন্ধু, দিল্লি পুলিশেরর এক আধিকারিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল সেদিন । সেই আইপিএস এখন অবসরপ্রাপ্ত। বলছিলেন, রেখা বরাবরই সংসার করতে চেয়েছিলেন। সন্তান চেয়েছিলেন, এমনকি তারকা জীবন থেকে বের হয়ে আসতেও চেয়েছিলেন। তবে ভাগ্য হয়ত তাঁর জন্য অন্য কিছুই লিখে রেখেছিল।

কে জানে রিয়াও হয়ত সুশান্তের সঙ্গে রেখার মতোই ঘর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এখন জেলে। তাও সুশান্তের মৃত্যুর ঘটনায় নয়, মাদক কান্ভের জেরে। তাও তিনি আইনের চোখে দোষী সাব্যস্ত নন, অভিযুক্ত মাত্র। মায়া নগরীতে তাঁর কেরিয়ার ধ্বংসের মুখে। এই মুহূর্তে রিয়াকে হয়ত একমাত্র উপলব্ধি করতে পারেন রেখাই। নিয়তিই বলতে পারে রিয়ার ভবিষ্যৎ।

লেখাটি লাইক, শেয়ার, কমেন্টস করলে উৎসাহিত হব। প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন। ভালো লাগবে।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img