দেবদাস কুণ্ডু
লোকটা বলেছিল, ‘আশি হাজার টাকা লাগবে।’
‘কেন?’ আমি প্রশ্ন করেছিলাম।
লোকটার হাতে বিল্ডিং প্ল্যান। সেটা মেলে ধরে বলল, ‘দেখুন প্ল্যানে আছে বেডরুম আট বাই আট। কিন্তু করেছে দশ বাই বারো। ক্যান্টিলিভার দিয়ে বাড়িয়েছে। প্ল্যানে আছে বারান্দা চার বাই ছয়। করেছে দশ বাই চার। এখানেও সেই ক্যান্টিলিভার। এতো গন্ডগোল সামাল দিতে গেলে টাকা লাগবে না?’
‘তা বলে আশি হাজার?’
‘আটটা ফ্ল্যাট। দশ হাজার করে পড়বে। বলুন কি করবেন?
‘কম করে করা যায় না?’
‘দেখুন টাকাটা আমি একা নেবো না। সকলের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে।’
‘সকলে বলতে?’
‘বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টের ইঞ্জিনিয়ার অফিসার ক্লার্ক আরও অনেকে আছেন। আপনাদের সি সি সার্টিফিকেট নেই।’
আমি গত সপ্তাহে কর্পোরেশন অফিসে গিয়েছিলাম। তখন অফিসার বলেছিলেন, ‘মিউটেশনের জন্য সিসি সার্টিফিকেট লাগবে।
‘আছে?’
‘না।’
ফ্ল্যাট কিনলেন কেন?’
‘কি করে জানবো প্রোমোটার সি সি দেবে না।’
‘এখন প্রোমোটার কি বলছেন?
‘বলছেন আরও দুটো ব্লক হবে, তখন সবকটার সিসি একসঙ্গে দেবে।’
‘আর দেবে না। কাজ কমপ্লিট করে পালাবে।’
‘এখন কি করবো সেটা বলুন?’
‘ওনার সঙ্গে কথা বলুন।’
আঙুল দিয়ে কোণার টেবিল দেখিয়ে দিলেন। সেই টেবিলের লোকটি আজ এসেছে। সেদিন টেবিল নিয়ে যেমন বসে ছিলেন, আমার মনে হয়েছিল, উনি অফিস স্টাফ। এখন বুঝতে পারছি উনি দালাল। চা শেষ করে লোকটি বলল, ‘এখন সুয়োমোটো হবে।’
‘সুয়োমোটো মানে? ‘
‘প্রাইমারি হবে। পরে নামে নামে মিউটেশন হবে।’
আটজন ফ্ল্যাট হোল্ডার আমার ঘরে বসে আছে। টাকার পরিমাণ শুনে সকলের মুখ ভার। স্বাভাবিক। পার ফ্ল্যাট দশ হাজার! কম কথা নয়। তবু সকলে রাজি। মিউটেশনটা হওয়া দরকার। কিন্তু তিনতলার পোদ্দারদা বললেন. ‘আমি দশ হাজার দিতে পারবো না।’
মিউটেশনটা হলো না।
2011 সাল। সরকার পরিবর্তন হয়েছে। একদিন দুপুরে কলিং বেল বেজে উঠলো। ঘরে ছিলাম। দরজা খুলতে দেখি একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, ‘আপনাদের বিল্ডিং মিউটেশন হয়নি। এবার করে নিন। আমি এই অঞ্চলের নতুন অফিসার। আমার নাম পলাশবাবু।’
‘কিন্তু আমাদের সিসি নেই। আর আশি হাজার টাকা দিতে পারবো না।’
‘সিসি ছাড়া সব কাগজ আছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘হয়ে যাবে। অফিসে আসুন কাগজপত্র নিয়ে। মাত্র একশো টাকা লাগবে।’
বলে কি লোকটা? পাগল নাকি? ‘
‘বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো?
‘হ্যাঁ।’
‘অফিসে আসুন না একবার।’
‘মাত্র একশো টাকা?
‘হ্যাঁ। ফর্মের দাম একশো।’
‘আপনি সব ঘরে ঘরে বলে আসুন। আমার এই কথা কেউ বিশ্বাস তো করবে না। পাগলা গারদে ভর্তি করে দেবে।’
অফিসার তাই করলেন। আর আশ্চর্য সব কাগজপত্র ফাইল করে জমা দিলাম। হেয়ারিং হলো। বছরে চার হাজার টাকা ট্যাক্স। মিউটেশন হয়ে গেল। সেদিন বিল্ডিং সেকশনে গিয়ে ঐ লোকটাকে অনেক খুঁজেছি। বেটা নেই।
পরদিন মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে গেছি। পলাশবাবু তা দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে পালাছে। কি ব্যাপার? এতো বড় উপকার করলেন, একটু মিষ্টিমুখ করাবো। আর মানুষটা পালাচ্ছে। আমি বলি, ‘কোথায় যাচ্ছেন? এদিকে আসুন। মিষ্টিমুখ করে যান।’
‘মিষ্টি নিয়ে পালান। আমার চাকরি চলে যাবে। চারপাশে ভিজিল্যান্স ঘুরছে। আমার এতো বড় সর্বনাশ করবেন না।’
মিষ্টি যে কখনও বিষ হতে পারে সেদিন বুঝেছিলাম।